বালির কোনো স্থিতিশীলতা নেই, পরিমাণে তা যত বেশিই হোক। বাতাস অনায়াসেই তাকে দিগ্বিদিক উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। যেকোনো ছোট-খাটো তাকে নিস্তানাবুদ করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু পাথর বা টিলার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাহাড়ের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সে নিজেকে স্থায়ী করে নেয়। সেখান থেকে নড়ে না। ঝড়-ঝাপটা নিয়ে তার কোনো ভয় নেই।
তুফান যখন বালুকণাকে অর্থহীন, শক্তিহীন প্রমাণ করে, ঠিক সে সময় পাহাড় নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবে৷ কারণ মানুষের চোখে নিজের শক্তিমত্তা আর স্থিতিশীলতা প্রমাণের এই তো সুযোগ! এবং সে সুযোগটাকে কাজে লাগায়ও খুব ভালো করেই।
তাহলে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে— দুজনের উপাদান (প্রকৃতি) এক হওয়া সত্ত্বেও কেন আকাশ পাতাল তফাৎ।
বালুকণা হচ্ছে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রস্তরখণ্ড৷ আর পাহাড় হচ্ছে জমাটবদ্ধ বালুর সমষ্টি। দুইয়ের উপাদান যেহেতু অভিন্ন, সেহেতু একজন ঝড়ের সামনে বেসামাল, আরেকজনের কাছে ঝড় কিছুই না। অর্থাৎ বালুকণা আর পাহাড়ের মধ্যকার পার্থক্য হলো অনৈক্য আর ঐক্যবদ্ধতার৷
বালুকণা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদেরকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। আর পাহাড় জমে থেকে নিজেকে সুদৃঢ় মজবুত প্রমাণ করেছে।
মানবজীবনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কোনো জাতির সদস্যরা যখন অনৈক্যের চোরাবালিতে পতিত থাকে, পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকে, তখন সমাজে ওই জাতির কোনো প্রভাব থাকে না, কোনো শক্তিমত্তা থাকে না।
সংখ্যাধিক্যও কোনো কাজে আসে না তখন। সর্বক্ষেত্রে তারা নিজেদের অন্যদের তুলনায় দুর্বল, অযোগ্য প্রমাণ করে। বহিঃশক্তির মুহুর্মুহু আক্রমণ তাদের ধূলোবালির মতো উড়িয়ে ফেলে৷
পক্ষান্তরে তাদের সামষ্টিক চিত্র যদি এমন হয় যে, নিজেদেরকে তারা ঐক্যের সুতোয় বেঁধে রাখে, ব্যক্তিস্বার্থের দিকে না তাকিয়ে বৃহত্তর ও সামাজিক স্বার্থের কথা ভেবে মিলেমিশে থাকে, তাহলে যেকোনো মসিবত তারা সামাল দিতে সক্ষম হয়। তাদের হতে না হয় না টিটকারি-উপহাসের পাত্র৷ বহিঃশক্তির যেকোনো প্রভাব তারা পাহাড়ের মতো জমে থেকে খর্ব করতে পারবে। কেউ সে জাতিকে নড়াতে পারবে না।
মানবজীবনের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা হচ্ছে বাস্তবের মুখে টিকে থাকা না-থাকার। যারা টিকে থাকতে পারে, তাদের পরস্পর বিচ্ছিন্নতার যেকোনো সঙ্কট নিরসন হয়ে যায়। তারা মতানৈক্য ভুলে এক হতে পারে।
বাস্তবতার প্রেক্ষিতে জীবনযাপনকারীদের পারস্পরিক সম্পর্ককেই বলে ঐক্যবদ্ধতা। আর বাস্তবতা ভুলে যারা জীবনযাপন করে, তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে বলে অনৈক্য বা বিচ্ছিন্নতা।