সোমবার, ১২:২১ অপরাহ্ন, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

তামিমদের এমন আচরণে শুধুই বিস্ময় আর হতাশা

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০২৪
  • ৩৬ বার পঠিত

বুধবার দিনটা ছিল তামিম ইকবালের জন্মদিন। একজন ক্ষণজন্মা ক্রিকেটার, যার হাত ধরে এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক স্মরণীয় জয়। দেশের ক্রিকেটে অনেকগুলো রেকর্ডের মালিকও এখনো তিনি। এদিন তার ভেসে যাওয়ার কথা ছিল শুভেচ্ছার বন্যায়। ভেসেছেনও। কিন্তু তাকে নিয়ে এদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা লিখা হয়েছে তার সবই শুভেচ্ছাময় ছিল না।

ভালোবাসায় ভাসিয়ে দেয়ার বদলে বেশির ভাগ মানুষই সমালোচনায় ডুবিয়েছেন তামিমকে। একটি সংস্থার বিজ্ঞাপনী প্রচারে অংশ নিতে গিয়ে নিজেকে তিনি খুবই সস্তা বানিয়ে ফেলেছেন কিনা- সেই আলোচনাও হয়েছে। বিশ্বকাপের আগে থেকেই জাতীয় দল থেকে তার ছিটকে পড়া ও ফিরে আসার পথ ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে যাওয়ার জন্য আকারে ইঙ্গিতে তামিম অনেকবার অন্যদের দায়ী করেছেন। কিন্তু এবার যে সমালোচনার মুখে তিনি পড়েছেন, তাতে অন্য কাউকে দায়ী করার সুযোগ তিনি একেবারেই পাচ্ছেন না। মোবাইল ফাইনান্সিং কোম্পানি নগদের হয়ে বিতর্কিত এই প্রচার কাজে যে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফেসবুক লাইভে এসে নিজেই আবার এটাকে বলেছেন, ‘নাটক’।

ঘটনার সূত্রপাত যদিও একদিন আগে। ৭১ টেলিভিশন চ্যানলের খেলাযোগ বিভাগ ফাঁস করে বসলো তামিম আর মেহেদী হাসান মিরাজের টেলিফোন সংলাপ। রীতিমতো প্রাইম টাইম বুলেটিনে এটা প্রচার করা হলো সংবাদ হিসেবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো দেয়া হলোই। কণ্ঠস্বর, বাচন ভংগি কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ করার সামান্যতম অবকাশও ছিল না। ফাঁস হওয়া এই সংলাপে তামিমের সাথে মুশফিকুর রহিমের সম্পর্কের অবনতি ঘটার আলামত স্পষ্ট। মুশফিক তাকে বাদ দিয়ে কোনো এক নতুন দল গড়ছেন তা নিয়ে তামিমের যত উষ্মা। নড়েচড়ে বসল দেশের ক্রিকেট প্রেমীরা।

এমনিতে সাকিব-তামিমের সম্পর্কের অবনতি ঘটায় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। এখন মুশফিকও যদি তাদের এই শীতল যুদ্ধে যোগ দেন সেটা হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য আরেক অশনি সংকেত। চারদিকে তাই শুরু হয়ে যায় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। কিন্তু রাতে যা ছিল উদ্বেগ সকাল নামতেই সেটা বিরক্তিতে রূপ নেয়। কারণ, ঘটনা ততক্ষণে অনেকেই জেনে গেছেন।

তামিম-মিরাজের এই সংলাপ, যাকে পরে অনেকেই প্রলাপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, তা আসলে ছিল সাজানো। মোবাইল ব্যাংক নগদের বিজ্ঞাপনী প্রচারণার অংশ। টেলিভিশনের দর্শকরা এতে প্রতারিত বোধ করেছেন। তামিম, মিরাজের ভক্তরা হয়েছেন হতাশায়, বিষ্ময়ে বিমূঢ়। অল্প কিছু ‘সুবিধা’র বিনিময়ে তাদের প্রিয় ক্রিকেটাররা নগদের হয়ে এ ধরনের ভুয়া টেলিফোন সংলাপের নাটক সাজাতে পারেন এটা ছিল অনেকের কাছেই ভাবনার অতীত।

ঘটনা চাউর হতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঢেউ উঠে। তামিম বলেছিলেন, সন্ধ্যায় ফেসবুক লাইভে আসবেন। তাতে কেউ কেউ আশাবাদী হয়েছিলেন এই ভেবে যে হয়তো তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু কিসের কী। লাইভে তিনি ঠিকই এসেছেন। সাথে মিরাজকে তো এনেছেনই। মুশফিক আর মাহমুদুল্লাহকেও ডেকে এনে একসাথে গায়ে কালি মেখেছেন। সিংহভাগ ক্রিকেটপ্রেমীর প্রতিক্রিয়া অন্তত তেমনই।

তামিম-মিরাজদের এই ভুয়া টেলিফোন সংলাপ নাটকে সংবাদ প্রচার ও পণ্য বিপণনে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতার মান নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। একটি সংবাদ মাধ্যম কোনো ধরনের ডিসক্লেইমার না দিয়ে জেনে শুনে সাজানো কিছু খবর হিসেবে প্রচার করতে পারে কিনা- সেই প্রশ্ন তো উঠেছেই, একইসাথে এটাও আলোচনায় এসেছে যে, পণ্য বিপণনের কাজে কেউ জাতীয় কোনো আবেগ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারে কিনা?

স্টেইট বিশ্ববিদ্যালয়ের, সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের প্রধান, সহযোগী অধ্যাপক মো: সামসুল ইসলাম দুটি বিষয়ের কোনোটিকেই সমর্থন করতে পারেননি। ‘সাংবাদিকতার শিক্ষক হিসেবেই নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও বলতে পারি এটা সাংবাদিকতার নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সাংবাদিকতা এবং বিজ্ঞাপন, তাদের একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে এবং যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা এই সীমা রেখার একটা সুস্পষ্ট লঙ্ঘন আমরা বলতে পারি। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শুধু সাংবাদিকতা নয়, বিপণন কৌশল হিসেবেও এথিক্যালি এটা ঠিক নয়।’

ক্রিকেটারদের প্রত্যেককে তিনি মনে করেন একজন কালচারাল আইকন। একজন ক্রিকেটার কোনোভাবেই এ ধরনের ক্যাম্পেইনের সাথে যুক্ত হতে পারেন না- এমন অভিমত জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এ ধরনের আচরণ সাধারণ জনগণের সাথে একরকম প্রতারণা।’ নগদকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তাদের এই বিপণন কৌশল দেশের জনগণ ভালোভাবে নেয়নি।’

সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক এম এম কায়সারের কাছেও পুরো বিষয়টা মনে হয়েছে খুবই ‘সস্তা কাজ’। সংবাদ সম্প্রচার ও পণ্য বিপণনে নীতি নৈতিকতার বড় ধরনের বিচ্যুতি যে এখানে ঘটেছে সে বিষয়ে তিনিও একমত। পাশাপাশি, এই ঘটনার পর যে ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে সেই আশঙ্কাও তিনি ব্যক্ত করেছেন। পাতানো টেলিফোন সংলাপে তামিম যেভাবে মিরাজকে বলেছেন, আমি ক্যাপ্টেন থাকলে তো এভাবে করতে পারতি না, সেই প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, ক্যাপ্টেন হলেই যে তাকে নম নম করতে হবে, তার আশেপাশে থাকতে হবে, তাকে তেল দিতে হবে, এ ধরনের কথায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে।

এমনিতেই স্পট ফিক্সিং বিতর্কের পর খেলোয়াড়দের অনেক পারফরমেন্সকেই সাধারণ মানুষ আজকাল সন্দেহের চোখে দেখে। এই ঘটনার পর কোনো ক্রিকেটার সত্য বললেও মানুষ বিশ্বাস করবে কিনা- সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, এখন কোনো ক্রিকেটার যদি কেঁদেকেটেও স্ট্যটাস দেন, আমার মা মারা গেছেন সেটাও লোকজন প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইবে না, ভাববে এটাও বোধ হয় কোনো ক্যাম্পেইনের অংশ।

নিজেদের কাণ্ডে অন্য খেলোয়াড়দের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়া এই চার খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন সাংবাদিক কায়সার। তামিম এখানে পালের গোদা হলেও পুরো বিষয়টিতে অন্য ক্রিকেটারদের দায়ও দেখছেন তিনি। এদের তিনজন সাবেক জাতীয় অধিনায়ক। একজন যিনি এখনো অধিনায়ক হতে পারেননি, তিনি অনূর্ধ্ব ১৯ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সব ফরম্যাট খেলার উপযুক্ত থাকলে ক্যাপ্টেন না হোক এখন তার ভাইস ক্যপ্টেন থাকার কথা। পণ্য প্রচারে একজন ক্রিকেটার কতটুকু কী করতে পারেন, কোথায় থামতে হবে, কতোটা নিচে নামলে তলানিতে পৌঁছে যায় মানুষ এসব তাদের ভালোই জানার কথা।

এমন চারজন খেলোয়াড় একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন, তাতে ক্রিকেটের সামগ্রিক ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যদিও এই ব্যাপারে ক্রিকেট কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন সুজন বুধবার সন্ধ্যায় ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, ঘটনার আদ্যেপান্ত তিনি মাত্রই জেনেছেন। ’বিজ্ঞাপনী প্রচারে অংশ নেয়াটা খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই বিষয়ে আমার এই মুহূর্তে কোনো বক্তব্য নেই’- বলেছেন তিনি।

তামিম, মুশফিক, মিরাজ, মাহমুদুল্লাহ- এই চারজনই নগদের পণ্য দূত। তাদের দিয়ে এরকম একটা ক্যাম্পেইন করিয়ে নিতে পারায় নগদ সংশ্লিষ্টদের তাই খুশির শেষ নেই। নগদের হেড অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম সজল যেমনটা বলেছেন, ‘বিপণন কাজে মজা করা বা ইমোশনাল টাচ দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা সবসময় থাকে। এটি আসলে সব জায়গায় দেখা যায়, সব বাজারেই মোটামুটি দেখা যায়, এখানেও আমরা খুব নির্জলা মজা করার চেষ্টা করেছি।’

তার দাবি- এই ক্যাম্পেইনে কাউকে কোনোভাবে কটাক্ষ করা হয়নি। কারো অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হয়নি, কোনো ধরনের উস্কানিমূলক শব্দ, বাক্য বা ইঙ্গিতও এখানে নেই। তাদের জানামতে কোনো ধরনের আইনগত বাধা নিষেধও তারা এখানে পাননি। ক্যাম্পেইনটেকে তারা সফল ভাবছেন। কারণ এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

ক্ষতি যা হয়েছে তা কেবল ক্রিকেটেরই। অনলাইন অ্যকিস্টভিস্ট আরিফ জেবতিক যেভাবে বলছেন নিজের ফেসবুক পেইজে- ‘দুইদিন বাদে যদি কেউ খবর প্রকাশ করে যে, অমুক ক্রিকেটার মারা গেছে, আপনারা জানাজায় আসুন। তাহলে অনেক লোকই সেই লাশকে খোঁচা দিয়ে দেখবে যে আদৌ মারা গেছে নাকি নগদের বিজ্ঞাপন করতেছে।’ ডয়চে ভেলে

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com