বিশ্ব শরণার্থী দিবস আজ। বর্তমানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির উখিয়া-টেকনাফ এবং ভাসানচরে অবস্থানরত সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশের কাঁধে। আর এ মুহূর্তে আট কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এটিই সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে শরণার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশের উৎস পাঁচটি দেশ সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান ও মিয়ানমার। এ ছাড়া সহিংসতার কারণে কঙ্গো থেকেও কয়েক লাখ মানুষ শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন। বিশ্ব শরণার্থী দিবসে বাণী দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস।
বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অবস্থানকাল পাঁচ বছর হয়ে গেল। জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান বাড়তি একটি চাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। দিন যত যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। তাই তাদের প্রত্যাবাসন খুব জরুরি। কিন্তু মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের
ফিরিয়ে না নিতে নানা টালবাহানার আশ্রয় নিচ্ছে। ১৫ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে প্রত্যাবাসন। এদিকে গতকাল বিশ^ শরণার্থী দিবস সামনে রেখে ‘গো হোম’ বা ‘বাড়ি চলো’ স্লোগানে মহাসমাবেশ করেছে কক্সবাজার ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা। সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে বিশাল মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। থেমে থেমে হালকা বৃষ্টির মধ্যে শুরু হয় সমাবেশ। লাখো রোহিঙ্গার উপস্থিতি আশা করা হলেও বৃষ্টি ও বৈরী পরিবেশের কারণে তা সম্ভব হয়নি। সমাবেশে যোগ দেন ১৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা। সমাবেশে মুহিবুল্লাহ হত্যাকা-ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে সাত দফা ঘোষণা পড়ে শোনানো হয়।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন শুরু ১৯৭৮ সাল থেকে। এরপর কারণে-অকারণে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে রোহিঙ্গারা। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক আগমন ঘটে। রাখাইনে সহিংস ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্প ও ভাসানচরে আশ্রয় নিয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে।
এদিকে গত ১৪ জুন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) সর্বশেষ বৈঠকও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ চায়, এ বছরই প্রত্যাবাসন শুরু করতে। বৈঠকে অতীতের মতোই বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা এবং জটিলতার বিষয়গুলো উত্থাপন করে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে বাংলাদেশ যে প্রস্তুত সে বার্তাও দেওয়া হয়। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের নির্বিঘ্নে ঘরে ফেরা নিশ্চিত করতে রাখাইনে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ঢাকার পক্ষ থেকে সে জিজ্ঞাসাও ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষে উপযুক্ত জবাব না দিয়ে বলা হয়, রাখাইনের প্রত্যাবাসনবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করবে নেপিদো।
গতকালের সমাবেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলা যেন না হয়, সে ব্যাপারে মাঠে তৎপর ছিল আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (আরএসপিএইচ) রোহিঙ্গা নেতা জুবাইর, মাস্টার ইউসুফ, মাস্টার আবুল কামাল ও মাস্টার নুরুল আমিন। শুরু থেকে প্রচারের সঙ্গে এআরএইচপিএইচ নেতাকর্মী ও সমর্থকরা জড়িত থাকলেও সমাবেশ হয়েছে ‘নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী’ ব্যানারে।
সাত দফা দাবি হচ্ছে, দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন, ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল, দ্রুত রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ গ্রামে প্রত্যাবাসন, রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কার্যকর করা, রাখাইন রাজ্যে আইডিপি ক্যাম্প বন্ধ করা ও তাদের (রোহিঙ্গাদের) নিজ গ্রামে ফিরিয়ে নেওয়া এবং মিয়ানমারে নিরপরাধ লোকজনের ওপর (রোহিঙ্গা মুসলমান) অত্যাচার বন্ধ করা।
উখিয়ার জামতলী (ক্যাম্প-১৮) আশ্রয়শিবিরের সিমকার্ড এলাকাতেও গতকাল খোলা মাঠে ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচির সমাবেশ হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে চলে সমাবেশ। এ সমাবেশেও সাত দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সমাবেশে জামতলীর আশপাশের তিনটি আশ্রয়শিবির (ক্যাম্প-১৪, ১৫ ও ১৬) থেকে ১১ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা যোগ দেয়।
অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, রোহিঙ্গারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানাচ্ছে। তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। তবে এখন পর্যন্ত মানববন্ধন ছাড়া রোহিঙ্গাদের বড় কোনো জমায়েত বা বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত ৮-এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) কামরান হোসাইন জানান, ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হচ্ছে। ক্যাম্প এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ৮-এপিবিএনের তৎপরতা সব সময় অব্যাহত আছে।
জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর শরণার্থী দিবস পালন করা হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৮ কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে রয়েছে। এটি বিশ্বের ইতিহাসে শরণার্থী সংখ্যার সর্বোচ্চ রেকর্ড। মূলত যুদ্ধ, জাতিগত সন্ত্রাসই সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থী সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ। রোহিঙ্গারাদের দাবি, শুধু প্রতি বছর শরণার্থী দিবস পালনে তারা অংশীদার হতে চান না। নিজ দেশে ফিরে বাংলাদেশের বোঝা হালকা করতে চান তারা।