দেশের স্বায়ত্তশাসিত, আধাস্বায়ত্তশাসিত ও স্থানীয় ১৩০ সংস্থার কাছে সরকারের বকেয়া ৩ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৯৩ হাজার ৬শ কোটি এবং বর্তমানে সুদ-আসল মিলে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা।
আর এক বছরে মোট বকেয়া বেড়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে যে বকেয়া রয়েছে, তা ১২টি পদ্মা সেতুর ব্যয়ের প্রায় সমান।
কোনো কোনো সংস্থা দীর্ঘদিন থেকে এসব অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে প্রতিবছরই বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ উত্তীর্ণ ও সুদ-আসল মিলে প্রতিষ্ঠানটির কাছে বকেয়ার পরিমাণ ৯১ হাজার ১০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ঢাকা ওয়াসার কাছে বকেয়া ৫১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমাহীন দুর্নীতি, অতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রভাব, প্রয়োজনের অধিক জনবল এবং ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বাড়ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দক্ষতা বাড়াতে এসব প্রতিষ্ঠানে সংস্কার জরুরি।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সবচেয়ে দুর্বলতা হলো দক্ষতার অভাব। এছাড়া দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব তো রয়েছে। এতে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বাড়ছে। তিনি বলেন, এ অবস্থা উত্তরণে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার দরকার। তার মতে, প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বাড়লে সামগ্রিকভাবে সরকারের রাজস্ব খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। এতে বাজেট ঘাটতি পূরণে ঋণনির্ভরতা কমে আসবে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য অনুসারে গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারের বকেয়া মোট ৩ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এই পরিমাণ বকেয়া চলতি অর্থবছরে সরকারের মোট কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি।
এছাড়া আগামী অর্থবছরের মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রার ৮২ শতাংশ। বকেয়া এই টাকা দিয়ে ১২টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। আগের বছরের একই সময়ে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বকেয়া ছিল ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেড়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা।
আবার মোট বকেয়ার মধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি, বর্তমানে আসল টাকা ৬৪ হাজার ৪১৫ কোটি এবং সুদের পরিমাণ ৯৬ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। একক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে সরকারের বকেয়া ৯১ হাজার ১০ কোটি টাকা। তাদের বিভিন্ন ঋণের বিপরীতে যেসব গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ সেবার অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। দেশে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের প্রচুর অর্থ ঋণ হিসাবে জোগান দিতে হয়েছে।
এরপরই রয়েছে ঢাকা ওয়াসা। প্রতিষ্ঠানটির বকেয়ার পরিমাণ ৫১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ২৯ হাজার ৭৯২ কোটি, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন ১৫ হাজার ৬৭ কোটি, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন ১০ হাজার ২০৪ কোটি, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি ৪৭ হাজার ৬৬ কোটি, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন ৭ হাজার ২১২ কোটি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কাছে ১৪ হাজার ৯৩৬ কোটি, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন ৭ হাজার ২৮৬ কোটি, বাংলাদেশ ইস্পাত প্রকৌশল কোম্পানি ২ হাজার ৮৩, ডেসকো ৩ হাজার ৫০৫ কোটি, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি ৩ হাজার ৪০২ কোটি, আশুগঞ্জ পাওয়ার সাপ্লাই ২ হাজার ৬৩৫ কোটি, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন ৪ হাজার ৬৭৬ কোটি, কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থা ৪ হাজার ৬৮৯ কোটি, সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি ৪৩৭ কোটি, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি ২ হাজার ৩৪১ কোটি, বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড ৩ হাজার ৫২২ কোটি, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ৪১০ কোটি, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ৫২০ কোটি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ করপোরেশন ১ হাজার ৪১ কোটি, বাংলাদেশ ব্যাংক ৮ হাজার ৪৭৭ কোটি, বাংলাদেশ ইনফ্র্যাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি ৯ হাজার ৩৯৩, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ২ হাজার ৭২ কোটি, ঢাকা সিটি করপোরেশন ৪৯৭ কোটি, চট্টগ্রাম ওয়াসা ৬ হাজার ১০৭ কোটি, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড ২ হাজার ৮১৮ কোটি এবং খুলনা ওয়াসা ২ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এসব সংস্থার কাছে সরকারের বকেয়া দীর্ঘদিনের। ইতোমধ্যে মোট টাকার ৫৪ শতাংশই মেয়াদ উত্তীর্ণ। বকেয়ার এই তালিকায় দেশের ৫৫টি পৌরসভাও রয়েছে।