গৃহশ্রমিকরা অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক সব দিক দিয়েই দুর্বল অবস্থানে থাকে। ফলে তাদের নির্যাতনে জড়িতদের সাজা হয় না বললেই চলে। সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, সমাজে বিচারহীনতা ও ভয়ের সংস্কৃতি বহমান। এ কারণে সাধারণ মানুষ বা দুর্বল মানুষের জন্যে ন্যায়বিচার পাওয়াটাই চ্যালেঞ্জ। যদিও-বা কোনো কোনো বিষয়ে মামলা হয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থের দাপট, পেশির দাপট এবং রাজনৈতিক দাপটের কাছে পরাস্ত হতে হয় দুর্বলদের। ফলে শুরুতে অথবা মাঝপথে আইনবহির্ভূত সমঝোতা লক্ষ করা যায়। সাক্ষী সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় এই দুর্বল মানুষের পক্ষে দ্বিধাহীনচিত্তে সাক্ষ্য দিতে কেউ এগিয়ে আসে না।
শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ, এদের শতকরা ৮০ ভাগই নারী। দেশে ১১টি দৈনিক সংবাদপত্রের তথ্যের ভিত্তিতে বিলসের গবেষণায় দেখা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে মোট ৩৩ জন গৃহকর্মী হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এছাড়াও গত ১০ বছরে (২০১১ থেকে ২০২১) ৫৮৫ জন গৃহকর্মী হতাহত হয়েছেন। সুনীতি প্রকল্প পরিচালিত বিলসের ২০২২ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে ৮৪ শতাংশ গৃহশ্রমিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। গৃহকর্মীদের ৬৭ ভাগ মানসিক, ৬১ ভাগ মৌখিক এবং ২১ ভাগ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সম্প্রতি, সিলেটে জান্নাত আক্তার (১৩) নামের এক কিশোরী গৃহকর্মীকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। জানা যায়, জান্নাত সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এলাকার ছৈলাখেল গ্রামের মো. জাকির হোসেনের মেয়ে। জান্নাত সিলেট নগরীর নবাব রোডের এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নার্স শাহনাজ আক্তার সাবিহার বাসায় গত দেড় বছর ধরে কাজ করে আসছে। ঐ বাসায় কাজ নেওয়ার কিছুদিন পর থেকে তার ওপর ভাত বেশি খাওয়াসহ নানা অভিযোগ-অপবাদ দিয়ে অমানবিক নির্যাতন করেন নার্স সাবিহা, তার স্বামী পলাশ মিয়া ও বোন রেহানা আক্তার। একটু অজুহাত পেলেই জান্নাতের ওপর নেমে আসত নির্যাতন। রান্নার কাজে ব্যবহার করা খুন্তি গরম করে জান্নাতের শরীরে ছ্যাঁকা দিতেন সাবিহা। গত ঈদুল আজহার সময় সাবিহা গ্রামের বাড়িতে যান। এ সময় তার সঙ্গে যায় জান্নাতও। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে অভিভাবকরা জিজ্ঞাসা করলে সে নির্যাতনের কথা জানায়।
কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদ জানান, জান্নাতের বাবা জাকির হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেছেন। তাকে নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এ নির্যাতনের ঘটনায় মামলা দায়েরের পর থেকে অভিযুক্তদের খুঁজছে পুলিশ। তারা সবাই পলাতক।
সম্প্রতি এক মানববন্ধনে আগত এক গৃহশ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলে, ‘আমি যে বাসায় কাজ করতাম সেই বাসার ম্যাডাম বাচ্চা নিয়ে স্কুলে চলে গেলেই তার স্বামী আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। আমাকে এমন ধরনের কথা জিজ্ঞেস করত, যার উত্তর আমি দিতে পারতাম না। ঐ স্যার আমার সাথে যা করেছে, তা আমি কোথাও বলতেও পারি নাই। যদি আমি এলাকায় থাকতে না পারি বা যদি কোথাও কাজ না পাই সেই ভয়ে।’
গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী আবুল হোসেন বলেন, প্রায় সব ঘটনার মতো এই ঘটনায়ও একটি মামলা হয়েছে। আসামি বর্তমানে জামিনে আছে। এ ধরনের আসামিদের জামিনে বাইরে থাকা অভিযোগকারীর সঠিক বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। তামান্না হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেয়েছে, এই মামলাটি যদি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০১০-এর আওতায় করা হতো, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেত না। ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযুক্তের বিচার হওয়া প্রয়োজন। তাহলে হয়তো আর কেউ গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন করতে ভয় পেত।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান বলেন, গৃহশ্রমিক নির্যাতন বা হত্যা মামলার ঘটনায়, দুই-একটি মামলায় রায় পাওয়া গেছে বা বিচার পাওয়া গেছে। বাদ বাকি ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো এমন ঘটনা আমার জানা নেই। হয়তো ১০ বছরে ১০টা এমন ঘটনা আছে। ৫০০ কেসের মধ্যে যদি ১০টার বিচার হয়ে থাকে, তাহলে বাকিগুলোর তো হয়নি। তাই সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।
গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব নাজমা ইয়াসমীন বলেন, গৃহকর্মীদের শ্রম আইন, ২০০৬-এ অন্তর্ভুক্তি করতে হবে, আইএলও কনভেনশন ১৮৯-এর অনুস্বাক্ষর এবং গৃহকর্মীদের প্রতি শোভন ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, বেশির ভাগ মামলায় আপস হয়ে যায়। থানা থেকে চার্জশিট দিতে দেরি করে। যারা মামলা করে তাদের কিংবা তাদের অভিভাবকদের আসামিরা টাকা দিয়ে আপস করতে রাজি করে ফেলে। ফলে মামলাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এই কারণে সাজা হয়েছে এমন মামলা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
লেখক মোরশেদা ইয়াসমিন পিউ