অন্য ভাষায় :
রবিবার, ০৬:৫৩ পূর্বাহ্ন, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের স্বীকৃতি

এম এ খালেক
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
  • ২০ বার পঠিত

এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিন। ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হওয়ার পর থেকে বিগত ৫৫ বছরে মোট তিনজন নারী অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার অর্জন করলেন। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অন্য দুজন নারী হচ্ছেন-এলিনর অস্ট্রম ও এন্থার দুফলো। অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিন এমন একটি বিষয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যা বহুল আলোচিত এবং একইসঙ্গে উপেক্ষিতও বটে। তিনি তার গবেষণায় গত ২০০ বছরের নারী শ্রমের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন।

অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিন মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারী শ্রমজীবীদের অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে তার গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছেন। কিন্তু তাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের নারী শ্রমিকদের অবস্থাও ফুটে উঠেছে। তার গবেষণায় যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে তা হলো, বিগত ২০০ বছরের নারী শ্রমের ইতিহাসে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এতে শ্রমজীবী নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। তারা শ্রমবাজারে উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছেন। নোবেল কমিটি তাদের স্বীকৃতিপত্রে বলেছে, অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিন নারী শ্রমজীবীদের অবস্থা নিয়ে যে গবেষণা করেছেন, তা ছিল বেশ আয়াসসাধ্য ও কষ্টকর। এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা ছিল বেশ জটিল ও শ্রমসাধ্য। কারণ নারী শ্রমজীবীদের তথ্য-উপাত্ত সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয় না। এক সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুরুষ শ্রমজীবীদের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করা হলেও নারীদের শ্রমবাজারে উপস্থিতি ও অবস্থা সম্পর্কে কোনো তথ্য সংরক্ষিত হতো না। তাই গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহকালে অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিনকে অনেকটা গোয়েন্দার মতো ভূমিকা পালন করতে হয়েছে।

নোবেল কমিটি তাদের মন্তব্যে বলেছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের পরিণতিতে কী ঘটছে, শ্রমজীবী নারীদের কর্মক্ষেত্রে এবং সংসারে অবস্থান কেমন হয়েছে-এসব বিষয়ে আমাদের জানার পরিধি উন্নত ও সমৃদ্ধ করেছেন অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিন। তিনি গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে, শ্রমবাজারে নারী-পুরুষের ব্যবধান সবসময়ই ছিল। বিশ্ব উন্নত হচ্ছে, আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কর্মজীবী নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে। এ দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ হয়তো একেক দেশ ও সমাজে একেক রকম। কিন্তু বাস্তবে কর্মজীবী নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।

নারী ও পুরুষ শ্রমজীবীর মধ্যে আয়ের ব্যবধান সব সমাজেই বিদ্যমান আছে। আগে যেমন নারী কর্মজীবীদের পুরুষের তুলনায় কম মজুরি দেওয়া হতো, এখনো তা বহাল আছে। নারীদের ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত ছোটবেলায়ই নেওয়া হয়। একটি মেয়ে কতদূর লেখাপড়া করবে, তা পরিবার থেকেই ঠিক করে দেওয়া হয়। সেই মোতাবেক তার বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। পরিবারের একটি ছেলে চাইলেই তার বিয়ের সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করতে পারে। কিন্তু মেয়েরা তা পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েদের শিক্ষা ও বিয়ের ব্যাপারে অভিভাবকরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এমনকি বাচ্চা নেওয়ার ক্ষেত্রেও নারীর ইচ্ছার প্রতিফলন খুব একটা ঘটে না। স্বামী অথবা পরিবারের অভিভাবকদের সিদ্ধান্তে নারীরা অনেক সময় বাচ্চা গ্রহণ করে থাকে। উন্নত দেশগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়ছে। উন্নত অনেক দেশে গত এক শতাব্দীতে মজুরি বা বেতনভিত্তিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সাধারণত মনে করা হয়, নারীরা পুরুষের তুলনায় কর্মশক্তির দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে; তাই তার মজুরি বা বেতন কোনোভাবেই একজন পুরুষের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, উনিশ শতকে কর্মক্ষেত্রে বিবাহিত নারীর অংশগ্রহণ কমেছে; কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে সেবা খাতের ব্যাপক বিস্তারের ফলে কর্মক্ষেত্রে বিবাহিত নারীর অংশগ্রহণ আবারও বৃদ্ধি পায়। নারীরা কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় বেশি বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকেন। বিশেষ করে বেতন-ভাতা ও মজুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে।

অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিনের গবেষণার ফাইন্ডিংসগুলো আসলে নতুন কিছু নয়। কালে কালে সব সমাজে একই চিত্র প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তবে গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নারীদের গৃহকর্মের কোনো আর্থিক মূল্যায়ন করা হয় না। পড়াশোনা সমাপ্ত করার পর একজন নারী তার পছন্দমতো কর্মে নিযুক্ত হতে পারবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ অভিভাবকরা মনে করেন, পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর মেয়ে বাড়িতে বসে থাকলে দুর্নাম হবে। তাই তাদের উদ্দেশ্য থাকে শিক্ষাজীবন শেষে কর্মসংস্থানের চেয়ে একটি ভালো পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়া। আর শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর একটি মেয়ে চাকরি করবেন নাকি গৃহকর্ম করবেন তা তার নিজের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না। শ্বশুর-শাশুড়ি এবং বিশেষ করে স্বামী যদি না চান, তাহলে কোনো গৃহবধূর পক্ষে চাকরিতে যোগদান করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে মেয়েটি যদি সবার মতামত উপেক্ষা করে চাকরি করতে চান, তাহলে সংসারে নানা জটিলতা দেখা দেবে।

দেশে সাম্প্রতিক সময় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে বলে আমরা দাবি করে থাকি। কিন্তু সেটা কোথায় বেড়েছে? প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে বললে তৈরি পোশাকশিল্পের কথা বলতে হয়। তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী। কিন্তু তৈরি পোশাকশিল্পে সম্পৃক্ত হয়ে একজন নারীর কতটা আর্থিক ক্ষমতায়ন হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার অবকাশ রয়েছে। যেসব নারী তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত আছেন, তাদের অধিকাংশই আসলে শ্রম শোষণের শিকার। তাদের কর্মসংস্থান অর্থনীতির পরিভাষায় কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অর্থনীতির পরিভাষায় কর্মসংস্থান বলতে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে একজন মানুষ তার স্ট্যাটাস অনুযায়ী পরিবারের ৪-৫ জন সদস্যের ভরণ-পেষাণ করতে পারলে তাকেই পূর্ণ কর্মসংস্থান বলা হয়। কিন্তু তৈরি পোশাকশিল্পে যেসব নারী শ্রমিক কাজ করেন তারা কি সেই পরিমাণ বেতন-ভাতা বা মজুরি পান?

আমাদের দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীদের উপস্থিতি লক্ষ করে অনেকেই উল্লসিত হতে পারেন। কিন্তু কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে নারী শ্রমিকদের ব্যাপক উপস্থিতি কেন ঘটানো হচ্ছে, তার খবর আমরা অনেকেই রাখি না। কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে (তখন এর নাম ছিল বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক) কর্মরত থাকা অবস্থায় ব্যাংক অর্থায়িত একটি ড্রাইসেল কারখানা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানে নারী শ্রমিকদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করে ম্যানেজারকে এর কারণ জানাতে বলি। ম্যানেজার যে উত্তর দিয়েছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, নারী শ্রমিকদের পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম মজুরি দিয়ে কাজ করানো যায়। তারা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে আসে বলে কোনো ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে না চাকরি হারানোর ভয়ে। নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের মতো কাজ ফেলে আড্ডা দেয় না। মূলত এসব কারণেই নারী শ্রমিকদের আমাদের কারখানায় প্রাধান্য দেওয়া হয়।

কিছুদিন পর দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ফার্নিচার তৈরি কারখানার মালিকের সঙ্গে আলাপ হয়। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে তিনি জানান, তার কারখানায় বিপুলসংখ্যক মহিলা কার্পেন্টার আছেন। তারা পুরুষ কার্পেন্টারদের মতোই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। অথচ এসব মহিলা কার্পেন্টারের বেতন পুরুষ কার্পেন্টারের তুলনায় অনেক কম। আমি ভেবেছিলাম, ভদ্রলোক সম্ভবত ভুল করছেন। নারীরা কার্পেন্টার হিসাবে কাজ করেন কীভাবে? তারা হয়তো সাহায্যকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তিনি আমাকে নিশ্চিত করে বললেন, ‘নারীরা আমাদের কারখানায় কার্পেন্টার হিসাবেই কাজ করছেন। একদিন আপনি আমার কারখানায় এসে দেখে যেতে পারেন।’

এই হচ্ছে বাস্তবতা। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তাদের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা আর্থিকভাবে শোষণের শিকারে পরিণত হচ্ছেন।

এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com