একটু ভূমিকম্প হলে সবাই আঁৎকে উঠে। একই দিনে পর পর বার বার ভূকম্পন শুরু হলে তো কোনো কথাই নেই। এই যেমন কিছুদিন আগে সিলেট এলাকায় দিনে আটবার ভূকম্পন অনুভূত হওয়ায় মানুষের মনে মহা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সিলেট থেকে ঢাকা বেশি দূরে নয়। তাই ঢাকাবাসীর মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
নভেম্ববরের ২৬ তারিখের ভোরবেলা ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকাসহ সারা দেশে কাঁপিয়ে মানুষের সুখনিদ্রা ভাঙিয়ে দেবার একদিন পরেই আবার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল চট্টগ্রামসহ দেশের নানা অঞ্চল। ভোর ৫টা ৪৬ মিনিটে মিয়ানমারের হাখা পাহাড়ি এলাকায় এর উৎপত্তি। (দৈনিক ইত্তেফাক ২৬.১১.২০২১)। পরের দিনও হাখা এলাকায় এর উৎস ছিল। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম শহরে চারটি বহুতল বাড়ি হেলে পড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক গ্রামে পাকা ও আধাপাকা চল্লিশটি ইটের তৈরি বাড়ি মাটিতে দেবে মিশে গেছে। রংপুর ও রাজশাহী নগরের মানুষও আতঙ্কে বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে পড়েছে। বিষয়গুলো মহা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কারণ, ভূমিকম্পের ফলে গ্রামের বাড়ি এভাবে ধ্বংস হবার খবর আগে কখনও জানা যায়নি। তাহলে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের ভয়ংকর বাণী কি ফলতে শুরু করল? এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?
আমাদের দেশে ভূমিকম্পের ভয়ে যেমন আতঙ্ক লক্ষ্যণীয়, বর্তমানে উন্নত বিশ্বে তেমন আতঙ্ক দেখা যায় না। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগে বিজ্ঞ মানুষ বড় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ঠেকানোর নানা কৌশল অবলম্বন করে চলেছে। তবুও প্রকৃতির কাছে মানুষ চরম অসহায়। যেমন করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে বর্তমানে সারা বিশ্ব এক টালমাটাল সময় পার করছে। কিন্তু মানুষ নাছোড়বান্দা। প্রাকৃতিক যে কোনো বিপর্যয় মোকাবিলা করতে এক সময় একটা উপযুক্ত উপায় খুঁজে বের করবেই। যেমনটা করেছে ভূমিকম্পের দেশ বলে খ্যাত জাপান।
দ্বীপদেশ জাপানে অনেকগুলো সুপ্ত ও জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। ফলে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কম-বেশি ভূকম্পন হয়ে থাকে। আমি উচ্চশিক্ষার জন্য সাড়ে পাঁচ বছর জাপানে ছিলাম। প্রথম দিকে ভূমিকম্পের একটু ঝাঁকুনি পেলেই খুব ভয় পেতাম। সেমিনার বা ক্লাশের সময় ভূমিকম্প হলে মনোযোগ ভিন্নদিকে চলে যেত। কিন্তু আশপাশে সবার দিকে তাকিয়ে দেখতাম তারা নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি। বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে তাৎক্ষণিকভাবে কী করতে হবে তাদেরকে ছোটবেলা স্কুলেই শেখানো হয়েছে। বাড়ি, অফিস, ক্লাশরুম সবকিছুর দেয়ালে কাঠ-প্লাইউডের আলাদা সংযোজন রয়েছে। হঠাৎ কোনোকিছু খুলে মাথায় পড়ে যাবার ভয় নেই। প্রতিটি কক্ষে ফায়ার এক্সস্টিংগুইসার লাগানো আছে। তাছাড়া স্মোক ডিটেক্টরের দ্বারা আগুন বা ধোঁয়ার সন্ধান পেলে সাইরেন বেজে উঠে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ভুমিকম্পের মাত্রা বেশি হলে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
আমার দ্বিকক্ষবিশিষ্ট ফ্যামিলি ছাত্রাবাসটি ছিল বেশ বড় ও উঁচু। আমরা আটতলায় থাকতাম এবং সেখানে লিফট দিয়ে ওঠানামা করতাম। একদিন রান্নাকরা অবস্থায় বড় ভূমিকম্প হলো। মনে হলো ভবনটি কাত হয়ে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ হয়ে গেল। তবে ভবনটিও আবার যথারীতি সোজা হয়ে দাঁড়াল। পরে জেনেছি ভবনটি ৮-৯ মাত্রার ভূকম্পন সহনশীল করে তৈরি করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে বিদ্যুৎ চালু হলে টিভিতে দেখলাম ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। রাস্তায় কোথাও ফাটল দেখা গেছে। সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়ে হয়েছে নিকটবর্তী সমুদ্র সৈকতগুলোতে। কয়েকটি চলন্ত গাড়ি ছিটকে পড়েছে রাস্তা থেকে। এছাড়া সাধারণ মানুষের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। ভূমিকম্প প্রবণতা বেশি হওয়ায় জাপানিরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে বহু গবেষণা করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ায় জানমালের তেমন কোনো ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই এই ভয়ংকর দুর্যোগের সাথে লড়াই করে বেঁচে আছেন।
আমাদের দেশে প্রতিবছর বন্যা, সমুদ্রঝড়, কালবৈশাখী ইত্যাদি হয়। সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর রাস্তায় জলজট হয়ে যানবাহনকে সাঁতার কাটতে দেখা যায়। সেগুলোর সঠিক সুরাহা করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ নাজেহাল হয়ে পড়েন। তার ওপর ভূমিকম্প যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।
পৃথিবীতে নিরবচ্ছিন্ন সুখের প্রত্যাশা করে অবুঝ মানুষ। কিন্তু এই ধরাধামে কিছুতেই তা শতভাগ সম্ভব নয়। এখানে রোগ, শোক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে কোনো সময় আসবেই। এজন্য আগাম প্রস্তুতি থাকলে মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মোকাবিলা করার সাহস ও সুযোগ তৈরি হয়। তখন ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়। এজন্য প্রয়োজন অনেক গবেষণা, অনেক সেমিনার, অনেক পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। সেসব পরিশ্রমের ফলাফল জনগণকে যথাসময়ে ঠিকভাবে অবহিত করে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখতে হয়। সেটা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জন্য প্রযোজ্য।
কিন্তু আমাদের দেশে ঘটনা ঘটে যাবার পর সেটা নিয়ে চেঁচামেচি করে থাকি। আগে কেন ব্যবস্থা নিই না সেটাই আমাদের ভীষণ দুর্বলতা। আমাদের দেশে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা লক্ষাধিক (জাগোনিউজ২৪.কম জুন ০৮, ২০২১)। সারাদেশে গগণচুম্বি অট্টালিকার সংখ্যা বাড়ছে। অল্প জায়গায় বড় বড় স্থাপনা ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি দেশ ও দেশের বাইরে থেকে আমাদের চারদিকে ভূমিকম্প বলয় তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি সিলেট এলাকায় একদিনে আটবার পর্যন্ত ভূকম্পন অনুভূত হওয়ায় মানুষের মনে মহা আতঙ্ক শুরু হলে কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে উঠেছেন। কিন্তু সেই পর্যন্ত গিয়েই ক্ষান্ত। আমাদের দেশের ভূমিকম্প বিশারদগণ গত কয়েক বছর যাবত গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে কিছু ভয়ংকর কথা শুনিয়েছেন। সেগুলো নিয়ে কী কাজ হয়েছে তা জনগণকে তেমনভাবে অবহিত করা হয়নি অথবা মানুষ সেগুলোর ব্যাপারে কেন সচেতন হয়নি তার কোনো জবাবদিহিতা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। এবছর হঠাৎ ভূমিকম্পের ভয়ংকর ভবিষ্যৎবাণী শুনে মানুষ বেশি ভয় পাচ্ছে- যা এই করোনা অতিমারীর সময়ে মানুষকে আরো বেশি দুর্বল করে তুলেছে।
যেমন, পরিবেশ টিভি, অক্টোবর ০২, ২০১৯ বলেছে, করোনাকালে ভূমিকম্প হলে উদ্ধারে লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিসমিক ভালনেরাবিলিটি আ্যাসেসমেন্ট অব বিল্ডিং অব ঢাকা আয়েজিত এক সেমিনারে বলা হয়েছে, ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৩০ লাখ মানুষ মারা যাবে। ৭ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এমন ভবন ঢাকায় খুব কম।
ঢাকায় ভূমিকম্পের প্রাণহানির মূলে থাকবে আগুন। ভূমিকম্পে গ্যাস লাইন বিস্ফোরিত হবে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ-এর কারণে আগুন জ্বললে মানুষ পুড়ে মারা যাবে। নগরে হঠাৎ বন্যা হবে। বিদ্যুতের তার পানিতে পড়ে মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবে। অন্ধকারে ডুবে যাবে শহর। রাস্তা ডুবে ব্লক হয়ে যাবে। খাবার পানির সংকট হবে। অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারবে না। (ইত্তেফাক জুন ১৭, ২০২১)।
ঢাকায় ভবনের দুর্বলতা গ্যারেজ, ধসে পড়বে নিচতলা কারণ, নিচে শুধু কলাম, দেয়াল নেই। একটি ভবনের দুধরনের ওজন ধাকে। একটি ডেডলোড বা বিল্ডিং-এর নিজের ওজন। অন্যটি লাইভলোড বা অন্যান্য সবকিছুর ওজন। বিদেশে গাড়ি পার্কিং তৈরি করা হয় বিল্ডিং-এর ভেতরের কোন তলায় অথবা ছাদে। বিশেষ করে সুপার মার্কেটের সব ছাদেই বিশাল গাড়ি পার্কিং লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশে পার্কিং করা হয় মার্কেটের নিচে যৎসামান্য, বাকিটা সরকারি রাস্তা দখল করে রাখা হয়। এটা যানজটের অন্যতম কারণ।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান বলেছেন, ঢাকার ভবনগুলো ৭ এর বেশি প্রেশার নিতে পারবে না। (সময় নিউজ, জুন ৩, ২০২১)। ঢাকায় চার লাখ বড় ভবন রয়েছে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে বিশ হাজার ধসে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইন্ডিয়া, ইউরেশিয়া, বার্মা এই তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশ। একটি জোরালো ভূকম্পনের শক্তি জমা হয়ে আছে এখানে।
১৮৯৭ সালের আসামের ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ১২৪ বছর পূর্ণ হয়েছে গত ১২ জুন। প্রতি ১০০ বছর পর পর বড় মাত্রার ভূমিকম্প আবার ফিরে আসে। সিলেটের ছোট ছোট মাত্রার ভূমিকম্প সেগুলো পূর্বাভাস কি না তা নিয়ে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ডাউকী ফল্টের পূর্বপ্রান্তে গত ৫০০ বছরেও বড় ভূমিকম্প হয়নি। তাই আরাকান, সিলেট, ডাউকী, ও আসামেও উৎপত্তি হতে পারে এই বড় ভূমিকম্পের।
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস জানার কৌশল এখনও আবিষ্কৃত না হওয়ায় অন্যান্য দুর্যোগের মতো এর বিরুদ্ধে আগাম কর্মসূচি নেবার উপায় নেই। প্রয়োজন শুধু সতর্কতা। শক্তিশালী ভূমিকম্প সহনশীল ভিত্তির যথাযথ টেস্ট পাস না করলে ঢাকাসহ দেশের আর কোথাও কোনো উঁচু ভবন বানানোর অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। ভুয়া, অবৈধ অনুমতি ঠেকানোর জন্য সর্বাগ্রে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। বাচ্চাদের জানানোর জন্য জাপানের মতো স্কুল থেকে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার। তাছাড়া প্রতিটি স্কুল, অফিস, মহল্লা সব জায়গায় প্রতিমাসে বা তিনমাসে একবার ভূমিকম্প সচেতনতার মহড়া দেওয়া উচিত। প্রতি এলাকায় কিশোর-যুবকদের নিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জামসহ ভূমিকম্প উদ্ধারকারী টিম তৈরি করা প্রয়োজন। প্রতিটি ক্লাবেও বাধ্যতামূলকভাবে ভূমিকম্প উদ্ধারকারী টিম তৈরি ও বিপদের সময় এক হুইসেলে সাহায্যের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কারণ, তাৎক্ষণিকভাবে তো আর ইন্টারনেটের সংযোগ খুঁজে পাবার উপায় থাকবে না। সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে যে কোনো আহ্বানে দ্রুত সাড়া দেবার মানসিকতা তৈরিমূলক কর্মসূচি এখনই নিতে হবে ও সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তাহলে আমাদের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের ভয়ংকর ভবিষৎবাণীতে ভয় না পেয়ে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
লেখক- প্রফেসর, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।