অন্য ভাষায় :
মঙ্গলবার, ১১:২১ অপরাহ্ন, ০৭ মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

পদ্মা সেতুর আনন্দ জ্বালানিতে ম্লান

ড. এ কে এম মাকসুদুল হক
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২২
  • ৮০ বার পঠিত

গত জুনে আমরা জাতির গর্ব হিসেবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেছিলাম। দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ সারা দেশের মানুষ আনন্দে-আত্মহারা হয়েছিল। বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক সত্ত্বেও দেশের সরকারবিরোধী শিবিরের মানুষগুলোও আনন্দিত হয়েছিল, আশায় বুক বেঁধেছিল, সম্ভাব্য উন্নয়নের ছোঁয়া সবাই পাবে। কিন্তু মাত্র এক মাসের কিছু দিন বেশি সময়ের ব্যবধানে পদ্মা সেতুর সেই আনন্দ ম্লান হতে যাচ্ছে। প্রথমে শুরু হয় মুদ্রাস্ফীতি দিয়ে। এক ডলারের মূল্য এক লাফে ৮৬ টাকা থেকে প্রায় ১২০ টাকায় উঠে যায়। ফলে শুরু হয় মূল্যস্ফীতি। এরই মধ্যে ১ আগস্ট বৃদ্ধি পায় ইউরিয়া সারের মূল্য। সারের মূল্য বৃদ্ধিতে কৃষির ওপর কশাঘাত পড়তে না পড়তেই জাতির ওপর আপতিত হয় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সুনামি। সমগ্র জাতি ভূমিকম্পের কম্পনের মতো আন্দোলিত হতে থাকে।

যে পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে তা ছিল অকল্পনীয় ও অদ্ভুত রকমের। গত ৫ আগস্ট গভীর রাতে হঠাৎ করে ৪২ শতাংশ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অক্টেনের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। সময়টি বেছে নেয়া হয় ছুটির দিন অর্থাৎ শুক্রবার দিনের আগের রাতে। বিশেষজ্ঞগণের মতে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাসে এত বেশি পরিমাণে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির নজির নেই। অক্টেনের মূল্যবৃদ্ধিতে উচ্চবিত্তরা বিরক্ত হয়েছেন; মধ্যবিত্তরা উদ্বিগ্ন হয়েছেন। কিন্তু ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য বৃদ্ধিতে পুরো জাতি সঙ্কটে পড়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে বরং ৩৯ শতাংশ কমেছে, আর আমাদের দেশে বাড়ানো হয়েছে ৫০ শতাংশ। বিশ্ববাজারে যেখানে প্রতি লিটার অক্টেনের মূল্য প্রায় ৬৪ টাকা সেখানে আমাদের এখানে ১৩৫ টাকা! আর ৯ মাস আগে ডিজেলের মূল্য বেড়েছিল ২৩ শতাংশ। এবার বাড়ল ৪২.৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯ মাসে ডিজেলের মূল্য বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। অথচ এ সময় বিশ্ববাজারে গড়ে সর্বোচ্চ মূল্য বেড়েছে ২০ শতাংশ। ভারতে পাচার রোধ করার জন্য এই মূল্যবৃদ্ধি বলে যুক্তি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ‘বিজিবি’ জানিয়েছে, জ্বালানি পাচারের কোনো সুযোগ নেই। আর যদি পাচারের ভয় থাকে তবে দেশের সীমান্ত রক্ষাবাহিনীকে খাটো করা হচ্ছে না তো? বলা হচ্ছে, ‘আইএমএফ’ জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে বলেছে। তাদের কাছে সরকার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়েছে (প্রথম আলো : ১৬/০৮/২০২২)। কিন্তু সরকারের সূত্র ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ ২০২২’ গত জুন মাসে প্রকাশ করেছে যে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার জ্বালানি তেল আমদানিতে কোনো ভর্তুকি দেয়নি (প্রাগুক্ত)। অন্য দিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণের সরকারি বক্তব্য ছাপিয়ে বিশেষজ্ঞরা নানাবিধ যুক্তি তুলে ধরছেন। বিশেষজ্ঞদের যুক্তিগুলো সারমর্ম করলে বোঝা যায়, সরকার মারাত্মক অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে। তাই রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্যই এই মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।

টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়ব লিখেছেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের টাকার রাজস্ব বাড়বে কিন্তু তাতে ডলার আয় বা রিজার্ভ বাড়বে না। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের যা রাজস্ব আয় তা খরচ হয়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ বেপরোয়া ঋণের সুদে এবং জনপ্রশাসনের অতিরিক্ত ব্যয়ে। যেহেতু সরকার এক অর্থ বছরেই রাজস্ব আয়ের চেয়ে বেশি ঋণ করেছে, তাই অভ্যন্তরীণ সুদের ভারে সরকার এখনই দিশেহারা। মূলত অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণ, সঞ্চয়পত্র ঋণের সুদের ব্যয় এবং সরকারের পরিচালনা খরচ মেটাতেই ‘জ্বালানি থেকে আয়ের উদ্যোগ’। সরকারের আয়-ব্যয়ের বৈষম্য রাজনৈতিক ইচ্ছাপ্রণোদিত (প্রথম আলো : ১২/০৮/২০২২)। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বা ‘বিপিসি’ গত ফেব্রুয়ারি-জুলাই মাসে আট হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে কিন্তু গত সাত বছরে ৪৮ হাজার ১২২ কোটি টাকা লাভ করেছে। বিভিন্ন ব্যাংকে ‘বিপিসি’-এর জমা রয়েছে ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। কাজেই গত কয়েক মাসের লোকসান সহজেই সামাল দিতে পারত। আবার সরকার ২০১৮-২০২২ এই চার অর্থবছরে জ্বালানি থেকে শুল্ক কর ও লভ্যাংশ বাবদ ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা নিয়েছে (প্রাগুক্ত)। অন্য দিকে, জ্বালানি খাতের বিনিয়োগের অর্থও এই ‘বিপিসি’ থেকেই নেয়া হয়ে থাকে বলে জানা যায়। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ‘বিপিসি’ প্রজেক্ট উন্নয়নে খরচ করেছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি ‘বিপিসি’র অনিয়ম দেখে ‘স্তম্ভিত’ হয়েছেন। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত অর্থবছরগুলোর প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার অডিট আপত্তি অনিষ্পন্ন রয়েছে বলে জানা যায় (প্রথম আলো : ২৪/০৮/২০২২)। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে বাজেট থেকে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত একটি শ্বেতহস্তির রূপ ধারণ করেছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ২০১২ থেকে ২০২২ পর্যন্ত গত ১১ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোকে সরকারকে পরিশোধ করতে হয়েছে। এর মধ্যে দেশী ১০টি কোম্পানির ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৪৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ওই কোম্পানিগুলোর স্বত্বাধিকারী কারা? সে ব্যাপারে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন! এরই মধ্যে আবার ব্যাংকগুলো সমস্যায় রয়েছে ঋণখেলাপির কারণে। যেখানে ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, এখন সেই পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে (প্রথম আলো : ১২/০৮/২০২২)। অন্য দিকে এ পর্যন্ত অর্থ পাচার হয়েছে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা (ডেইলি স্টার : ০৭/০৮/২০২২)। চলমান যে সঙ্কট তা মূলত অর্থনৈতিক সঙ্কট। এক কথায় টাকার অভাব! এই সঙ্কট এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। তেলের মূল্য বিশ্ববাজারে যখন কম ছিল তখন বিপিসি প্রচুর মুনাফা করেছে। কিন্তু সেই মুনাফা নিয়ে কোনো দূরদর্শী পরিকল্পনা ‘বিপিসি’ বা সরকার কেউ করেনি। দূরদর্শিতা থাকলে সরকারকে হঠাৎ এরকম নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধি রাতের আঁধারে করতে হতো না। তেলের মুনাফা সরকারের অন্য খাতে প্রবাহিত করা, সেটা দ্বারা ‘বিপিসি’ এর বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা, অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর মতো জাতির লাইফলাইন সদৃশ এই তেল থেকেও সরকারের প্রায় ৩২ শতাংশ শুল্ক ও ভ্যাট আদায় ইত্যাদি ছিল দূরদর্শিতার অভাব! সেই সাথে ছিল জ্বালানি খাতে দুর্বল ব্যবস্থাপনা। ‘বিপিসি’-এর এই লভ্যাংশ কোন কোন খাতে কিভাবে ব্যয় হচ্ছে তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করা, বিদ্যুৎ খাতে বিশাল খরচের সঙ্কুুলানের জন্য দীর্ঘদিন যাবত সাবসিডি বা ভর্তুকি দেয়া ইত্যাদিভাবে এক বড় রকমের অব্যবস্থাপনা বর্তমান এই পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী! আমাদের ভুল নীতিও কম দায়ী নয়। আমরা আমদানিনির্ভর জ্বালানিনীতি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছি। ২০১৪ সালে সমুদ্রজয়ের পর নিজস্ব জ্বালানি সম্পদের ওপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করিনি। এখনো আমরা সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানই শুরু করিনি যদিও মিয়ানমার তাদের অংশ থেকে গ্যাস উত্তোলনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তা ছাড়া কুইক রেন্টালের ওপর নির্ভর করে সেগুলোর সামর্থ্যরে পুরোটা বিদ্যুৎ না নিয়েই তাদের বিশাল অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ, রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ ইত্যাদি দিয়ে যাচ্ছি। ফলে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ডিজেল সরবরাহের চাপ কমানোর জন্য সারা দেশে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে ডিজেল কনসাম্পশান কমানোর চেষ্টা করছি। আর এতদিন যে টাকা সেখানে দিয়ে অর্থ সঙ্কট দেখা দিয়েছে তা পুরো করার জন্য জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করতে হয়েছে। অন্য দিকে তেল সরবরাহকারী দেশগুলোর সাথে কোনো প্রকার চুক্তিতে না গিয়ে অনেক বেশি মূল্যে স্পট মার্কেট থেকে তেল কিনছি।

ডলারের মূল্য, দ্রব্যমূল্য এবং সারের মূল্যবৃদ্ধির এমন সন্ধিক্ষণে তেলের মূল্যবৃদ্ধি মারাত্মক অর্থনৈতিক সঙ্কটের আভাস দিচ্ছে। চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। জনজীবন ওষ্ঠাগত। বিশেষ করে নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর ভয়ানক বিপদ আপতিত হয়েছে। সাধারণত ডিজেলের ওপর দেশের মৌলিক অর্থব্যবস্থা নির্ভরশীল। এর সাথে কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ এবং নিত্যপণ্যের সম্পর্ক সরাসরি সমানুপাতিক। নগর পরিবহনে ২২.২২ শতাংশ এবং দূরপাল্লার বাসের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬-১৭ শতাংশ। ডিজেলের প্রায় ৬৫ শতাংশই ব্যবহার করে পরিবহন খাত। ফলে পরিবহন ভাড়া বাড়ার সাথে সাথে নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। গরিবের খাবার মোটা চাল ৩০ টাকা থেকে ৫৫ টাকায় উঠেছে। অর্থাৎ নিম্ন আয়ের মানুষকে চালে ৮৩ শতাংশের বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। ‘গরিবের প্রোটিন’ ডিমের দাম উঠেছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা হালি। এদিকে আটার দামও ২৪ শতাংশ বেড়ে কেজিপ্রতি হয়েছে ৫৫ টাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি খাত। ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে ৩৭.৫ শতাংশ। সার কিনতেই কৃষকের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। এর মধ্যে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। মোট ডিজেলের ১৬ শতাংশ কৃষিতে ব্যবহৃত হয়। এমতাবস্থায় লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেল ব্যবহার বেড়ে গেছে সেচের জন্য। এই ভরা আমন রোপণের মৌসুমে এক দিকে লোডশেডিং অন্য দিকে অনাবৃষ্টি। এমতাবস্থায় ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি কৃষির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিলো। আগে সেচ ও চাষ দিতে বিঘাপ্রতি ১৪ হাজার টাকা লাগত; এখন লাগবে ২০ হাজার টাকা। এমতাবস্থায় আর্থিক সঙ্কটের কারণে কৃষকের ফসল ফলন অনেক কমে যাবে। আবার পরিস্থিতি এমনই থাকলে সামনের মৌসুমে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে। বোরো ধান মূলত সেচের ওপর নির্ভলশীল। এই মৌসুমের অনাবৃষ্টি বোরো মৌসুমে খরার সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই ডিজেলের দামের কথা চিন্তা করে বহু কৃষক বোরো ধান চাষে অনুৎসাহিত হয়ে পড়তে পারেন। ফলে এখনই কৃষির ব্যাপারে দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে দেশে খাদ্য সঙ্কট বা দুর্ভিক্ষের আঁচ লাগতে পারে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের ভারী, মাঝারি ও ছোট ছোট শিল্প সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাঁচামাল পরিবহন করে ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আসা, উৎপাদিত পণ্য জাহাজ ঘাটে বা ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার জন্য দুই দুইবার বাড়তি পরিবহন খরচ সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। ‘আরএমজি’ সেক্টরের একটি কাভার্ড ভ্যান আমদানি পণ্য ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নিতে খরচ হতো ২০ হাজার টাকা, এখন তা হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। এভাবে ভারী শিল্প যেমন ঢেউটিন, রড ইত্যাদি সব কিছুরই মূল্য লম্ফ দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। আরো চার কোটি দারিদ্র্যের হুমকিতে রয়েছে। এমতাবস্থায় গত জুন মাসেই মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৫৬ শতাংশ। এটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এবং দেশের আমজনতার অবস্থা কী হবে তা চিন্তা করলে গা শিউরে ওঠে!

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি দেশে সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি করছে। চুরি, রাহাজানি, ছিনতাই হঠাৎ বেড়ে গেছে। কয়েক দিন আগে উত্তরার এক এটিএম বুথে একজন ব্যবসায়ী টাকা তোলার সময় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। টাঙ্গাইলের সাম্প্রতিক চলন্ত বাসে ডাকাতি এবং গণধর্ষণের ঘটনা সবারই জানা। এরই মধ্যে খাগড়াছড়ির এক উপজাতি মা তার ছয় বছরের সন্তানকে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তির জন্য বিক্রি করতে বাজারে তুলেছিলেন!

মূল্যবৃদ্ধির চক্র থেকে কবর দেয়ার মূল্যবৃদ্ধিও বাদ পড়েনি। সম্প্রতি উত্তরায় সিটি করপোরেশন কবরে দাফন করার চার্জ বৃদ্ধি করেছে বলে জানা যায়। অর্থাৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় দেশে সামাজিক সমস্যা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির রাজনৈতিক প্রভাব হয়তো অনেক গভীর হতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারদলীয় নেতা নেত্রীরাও অত্যন্ত বিরক্ত। তারা এর নেতিবাচক প্রভাব অনেকটা আঁচ করতে পারছেন। সাধারণের কাছে তারা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছেন। কোনো কোনো নেতা এমন অভিনব পদ্ধতিতে তেলের মূল্য অবিশ্বাস্য রকম বাড়ানোকে সরকারের বিরুদ্ধে আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, অতি দ্রুত জ্বালানির ওপর শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করে মূল্য সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে। এর লভ্যাংশ অন্য কোনো খাতে ব্যবহার না করে জ্বালানি খাতেই কোনো ধরনের বিপর্যয় বা ক্রান্তিকাল অতিক্রমণের জন্য রাখতে হবে। আর এ খাতের সব ধরনের দুর্নীতি ও সিস্টেম লস বন্ধ করতে হবে। মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে যত দ্রুত সম্ভব কুইক রেন্টাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যেন ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার কোটি টাকা আর গচ্চা দিতে না হয়। স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি তেল কেনাকাটা না করে বরং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে জ্বালানি সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে একটি দেশপ্রেমিকসুলভ জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। দেশের গ্যাস অনুসন্ধান সম্পন্ন করে দেশীয় গ্যাস আহরণের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জ্বালানির বিষয়ে আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে উঠে নিজস্ব জ্বালানি উৎসের ওপর স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

দুই বছরের করোনার নেতিবাচক প্রভাব, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু আমাদের অদূরদর্শিতা, দুর্বল অর্থ ব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা ও উন্নয়নে টেকসইমূলক উপাদানের অভাবও কম দায়ী নয়। গত ১৩-১৪ বছরে দেশে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এতে ‘রিসিলিয়েন্স’ নামক উপাদান কতটুকু ছিল তা বিশ্লেষণ করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন অভাবনীয় রকম হয়েছে। কিন্তু মানুষের জীবন-যাত্রার মান, মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা, মানুষের জীবনের মূল্যমান, ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক সততা ও স্বচ্ছতা ইত্যাদির কতটুকু উন্নয়ন ঘটেছে তা আত্মসমালোচনা করার দাবি রাখে। নইলে পদ্মা সেতুর মতো এত বড় সাফল্যের আনন্দ-উদযাপন শেষ হতে না হতেই জ্বালানির নতুন মূল্য এসে সেই আনন্দকে একেবারে ম্লান করে দিচ্ছে কিভাবে?
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com