সোমবার, ০১:৩২ অপরাহ্ন, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

ধান-চাল সংগ্রহ নীতিমালায় উপেক্ষিত কৃষক

ড. জাহাঙ্গীর আলম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৫
  • ৫ বার পঠিত
আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। চলবে প্রায় মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত। একসময় বোনা আমনের প্রাধান্য ছিল বেশি। ধান কাটা প্রায় শেষ হয়ে যেত নভেম্বরেই।

বর্ষায় পানি বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠত ধানগাছ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে অবস্থিত আমার এলাকায় ওই ধানকে বলা হতো ‘বর্ষাল’ ধান। পরছুম, তিলবাজাল ইত্যাদি ছিল বিভিন্ন বোনা আমনের জাত। ধানের ছড়া ছিল কম।
নাড়া ছিল বেশি। এখন ওই জাতের ধান আর চোখে পড়ে না। কেবল হাওর এলাকা ছাড়া বোনা আমন কোথাও চাষ করে না কেউ। চাষ হয় শুধু রোপা আমন।
কাটা হয় একটু বিলম্বে। পুরনো জাতগুলো এখন উধাও হয়ে গেছে। নাজিরশাইল, পাইজাম ইত্যাদি এখন দৃশ্যমান নয়। মাঠে চোখে পড়ে ব্রি ধান ১১, ২২, ৮৭ কিংবা বিনা ধান-৭ এবং অন্যান্য উচ্চ ফলনশীল জাতগু। এগুলোর ছড়া বেশি।
নাড়া কম। বোনা আমনের চেয়ে রোপা আমন ধানের ফলন অনেক বেশি। খড় হয় কম। এই মৌসুমে কিছু ধান আছে সুগন্ধি। হৈমন্তিক শালি ধান। এগুলো পরিপক্ব হয়ে ওঠার সঙ্গে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। মাঠের আলপথে হেঁটে যেতে গন্ধে ভরে মন।একসময় আমন মৌসুমই ছিল ধান উৎপাদনের বড় মৌসুম। কালক্রমে তার পরিবর্তন ঘটেছে। বোরো মৌসুমে এখন ধানের উৎপাদন বেশি। আমন দ্বিতীয় এবং আউশ তৃতীয় স্থানে আছে। মোট উৎপাদিত ধানে আমনের বর্তমান হিস্যা প্রায় ৩৯ শতাংশ, বোরোর হিস্যা ৫৪ শতাংশ এবং আউশের হিস্যা ৭ শতাংশ। দেশের আবহাওয়ার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ধান উৎপাদনে মৌসুমভিত্তিক পার্থক্যের কারণে এই হিস্যায় তারতম্য ঘটে। তবে ঐতিহ্যগত কারণে এবং খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে আমন মৌসুম এখনো ধান উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। আমন ধান অনেকটা বৃষ্টিনির্ভর। পানি সেচের প্রয়োজন এ ক্ষেত্রে কম। সে কারণে ইদানীং এর চাষাধীন এলাকার পরিমাণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আমন ধানের চাষ হয়েছে প্রায় ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে। সম্ভাব্য উৎপাদন এক কোটি ৮১ লাখ টন চাল। এবার উৎপাদনের দৃশ্যপট সন্তোষজনক। প্রকৃত উৎপাদন সরকারি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি হবে বলেই ধারণা। এরই মধ্যে বাজারে কমতে শুরু করেছে চালের দাম।

এবার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সাত লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে আছে ছয় লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৫০ হাজার টন আতপ চাল এবং ৫০ হাজার টন ধান। সিদ্ধ চাল ক্রয়ের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা। আতপ  ৪৯ টাকা এবং ধান ৩৪ টাকা। গত বোরো মৌসুমের তুলনায় এবার আমন চালের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রতি কেজি এক টাকা। পক্ষান্তরে ধানের দাম কমানো হয়েছে কেজিতে দুই টাকা। সরকার চাল সংগ্রহ করে থাকে চাতালের মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। ধান কেনে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে। এবার চালের সংগ্রহমূল্য বৃদ্ধির কারণে লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরা। ধানের দর কমায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উৎপাদনকারী কৃষক। তা ছাড়া ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা খুবই কম নির্ধারণ করায় অনেক কম দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। ফলে তাঁরা ধান ক্রয় ও চাল বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রেই বেশি সুবিধা পাবেন। এটি সরকারের ব্যবসায়ীবান্ধব নীতি, কৃষকবান্ধব নয়।

উৎপাদন মৌসুমে সাধারণত কৃষিপণ্যের দাম কমে যায়। এ সময় সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে মজুদ গড়ার জন্য। সেই সঙ্গে উৎপাদনকারী কৃষকদের মূল্য সহায়তা দেওয়ার জন্য। পরে চালের দাম বাজারে বেড়ে গেলে সরকার সংরক্ষিত চাল অপেক্ষাকৃত কম দামে বাজারে ছেড়ে দেয় ভোক্তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য। এতে একদিকে কৃষক এবং অন্যদিকে ভোক্তা লাভবান হন। কিন্তু বর্তমান চাল সংগ্রহ নীতিমালায় লাভবান হন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় চালের বাজার। উৎপাদন মৌসুমে সরকারকে চাল সরবরাহ করার জন্য তাঁদের ওপর বেশ চাপ থাকে। এতে বাজারের স্বাভাবিক সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। চালের দাম থাকে চড়া। এ সময় বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হলে বর্ধিত দামের সুবিধা পান ব্যবসায়ীরা। তা না করে ন্যায্যমূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে উপযুক্ত মাত্রায় ধান সংগ্রহ করা হলে কৃষক লাভবান হবেন। বাজারে চালের দামে স্থিতিশীলতা আসবে। ব্যবসায়ীদের কারসাজি স্তিমিত হয়ে যাবে। সে কারণে মোট ধান উৎপাদনের ন্যূনপক্ষে ১০ শতাংশ সরকারিভাবে সংগ্রহ করা উচিত। এতে সরকারের বাজারে হস্তক্ষেপের সক্ষমতা বাড়বে।

দুই মাস ধরে খোলাবাজারে চাল বিক্রি এবং দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচি এগিয়ে নিতে গিয়ে সরকারের মজুদে ভাটা পড়েছে। সাধারণত চাল মজুদের পরিমাণ সাড়ে ১২ লাখ টনের নিচে নেমে এলে আমরা শঙ্কাগ্রস্ত হই। এটি আপৎকালীন মজুদের সীমারেখা। এ দিয়ে দেশবাসীকে ন্যূনপক্ষে ১৫ দিনের খাবার জোগান দেওয়া সম্ভব। ২০২০ সালে আমার এক গবেষণাপত্রে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। বর্তমানে নিরাপত্তা মজুদ কিছুটা বাড়িয়ে ১৩ লাখ টন নির্ধারণ করা উচিত। তবে ধান উৎপাদন মৌসুমের আগে এই সীমারেখা কার্যকর থাকা উচিত না। যত বেশি সম্ভব চাল বিতরণ করে বাজারে মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা উচিত। ধান কাটার মৌসুমে তা পুনর্ভরণ করা উচিত। এবার আমন ধানের উৎপাদন আশানুরূপ হয়েছে। সরকারি গুদাম পুনর্ভরণের সুযোগ এবার অনেক ভালো। তাই স্থানীয়ভাবে চাল সংগ্রহের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ধান-চাল সংগ্রহের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ন্যূনপক্ষে ১০ লাখ টনে উন্নীত করা উচিত।  সেই সঙ্গে আমদানির পরিমাণ সীমিত রাখা উচিত। বাজারে চালের দামে স্থিরতা বজায় রাখার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভালো উৎপাদন। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ পর্যাপ্ত হলে ব্যবসায়ীদের কারসাজি করে দাম বাড়ানোর তেমন সুযোগ থাকে না। কিন্তু আমদানি বাড়িয়ে বাজার স্থির রাখার প্রয়াস প্রায়ই ব্যর্থ হয়। অতীতে শুল্ক ও ভ্যাট হ্রাসের মাধ্যমে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি চাল আমদানি করেও বাজারের উচ্চমূল্যে ইতিবাচক সাড়া মেলানো সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না।  এতে কেবল ব্যবসায়ীদের মুনাফা বৃদ্ধি পায়।

আমন ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০ নভেম্বর থেকে। চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত। গত বোরো মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জিত হয়েছে। এবারও তা অর্জন সম্ভব হবে। মাঠে উৎপাদন ভালো হলে কৃষিপণ্য সংগ্রহের পরিকল্পনা সফল হয়। নতুবা তা ব্যর্থ হয়। গত বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন ছিল রেকর্ড পরিমাণ দুই কোটি ১৩ লাখ টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চাল আমদানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন। ফলে এ নাগাদ অভ্যন্তরীণ বাজারে চাল সরবরাহের কোনো কমতি ছিল না। তা সত্ত্বেও দাম বেড়েছে। মোটা চাল কেজিতে ৬০ টাকা, মাঝারি চাল ৭০ টাকা এবং চিকন চাল ৯০ টাকা ছুঁয়ে গেছে। এ সময় সারা পৃথিবীতে চাল, গম ও ভুট্টার দাম হ্রাস পেয়েছে। ওই বিশ্ববাজার থেকে পর্যাপ্ত আমদানির পরও বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়েনি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আউশ ধানের মৌসুমে চাল উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৩২ লাখ টন এবং চলতি আমনের সম্ভাব্য উৎপাদন প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টন হবে বলে নিশ্চিত করছে কৃষি সাম্প্রসারণ বিভাগ। আগামী বোরো মৌসুমে উৎপাদন ভালো হলে দেশে চালের কোনো ঘাটতি হবে না। এই প্রেক্ষাপটে সরকারি বাজেটে ৯ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। বেসরকারি পর্যায়ে এরই মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এরপর আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে আরো এক লাখ টন। আরো পাঁচ লাখ টন আমদানির পরিকল্পনা আছে। আগামী বোরো ধানের পূর্বাভাস অবলোকন না করে এরূপ চাল আমদানিকে নিরুৎসাহ করাই যুক্তিসংগত হবে। সামনের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে। চাল আমদানির বিষয়টি তাদের পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ থাকা উচিত।

 

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com