এবার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সাত লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে আছে ছয় লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৫০ হাজার টন আতপ চাল এবং ৫০ হাজার টন ধান। সিদ্ধ চাল ক্রয়ের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা। আতপ ৪৯ টাকা এবং ধান ৩৪ টাকা। গত বোরো মৌসুমের তুলনায় এবার আমন চালের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রতি কেজি এক টাকা। পক্ষান্তরে ধানের দাম কমানো হয়েছে কেজিতে দুই টাকা। সরকার চাল সংগ্রহ করে থাকে চাতালের মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। ধান কেনে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে। এবার চালের সংগ্রহমূল্য বৃদ্ধির কারণে লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরা। ধানের দর কমায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উৎপাদনকারী কৃষক। তা ছাড়া ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা খুবই কম নির্ধারণ করায় অনেক কম দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। ফলে তাঁরা ধান ক্রয় ও চাল বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রেই বেশি সুবিধা পাবেন। এটি সরকারের ব্যবসায়ীবান্ধব নীতি, কৃষকবান্ধব নয়।
উৎপাদন মৌসুমে সাধারণত কৃষিপণ্যের দাম কমে যায়। এ সময় সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে মজুদ গড়ার জন্য। সেই সঙ্গে উৎপাদনকারী কৃষকদের মূল্য সহায়তা দেওয়ার জন্য। পরে চালের দাম বাজারে বেড়ে গেলে সরকার সংরক্ষিত চাল অপেক্ষাকৃত কম দামে বাজারে ছেড়ে দেয় ভোক্তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য। এতে একদিকে কৃষক এবং অন্যদিকে ভোক্তা লাভবান হন। কিন্তু বর্তমান চাল সংগ্রহ নীতিমালায় লাভবান হন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় চালের বাজার। উৎপাদন মৌসুমে সরকারকে চাল সরবরাহ করার জন্য তাঁদের ওপর বেশ চাপ থাকে। এতে বাজারের স্বাভাবিক সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। চালের দাম থাকে চড়া। এ সময় বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হলে বর্ধিত দামের সুবিধা পান ব্যবসায়ীরা। তা না করে ন্যায্যমূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে উপযুক্ত মাত্রায় ধান সংগ্রহ করা হলে কৃষক লাভবান হবেন। বাজারে চালের দামে স্থিতিশীলতা আসবে। ব্যবসায়ীদের কারসাজি স্তিমিত হয়ে যাবে। সে কারণে মোট ধান উৎপাদনের ন্যূনপক্ষে ১০ শতাংশ সরকারিভাবে সংগ্রহ করা উচিত। এতে সরকারের বাজারে হস্তক্ষেপের সক্ষমতা বাড়বে।
দুই মাস ধরে খোলাবাজারে চাল বিক্রি এবং দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচি এগিয়ে নিতে গিয়ে সরকারের মজুদে ভাটা পড়েছে। সাধারণত চাল মজুদের পরিমাণ সাড়ে ১২ লাখ টনের নিচে নেমে এলে আমরা শঙ্কাগ্রস্ত হই। এটি আপৎকালীন মজুদের সীমারেখা। এ দিয়ে দেশবাসীকে ন্যূনপক্ষে ১৫ দিনের খাবার জোগান দেওয়া সম্ভব। ২০২০ সালে আমার এক গবেষণাপত্রে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। বর্তমানে নিরাপত্তা মজুদ কিছুটা বাড়িয়ে ১৩ লাখ টন নির্ধারণ করা উচিত। তবে ধান উৎপাদন মৌসুমের আগে এই সীমারেখা কার্যকর থাকা উচিত না। যত বেশি সম্ভব চাল বিতরণ করে বাজারে মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা উচিত। ধান কাটার মৌসুমে তা পুনর্ভরণ করা উচিত। এবার আমন ধানের উৎপাদন আশানুরূপ হয়েছে। সরকারি গুদাম পুনর্ভরণের সুযোগ এবার অনেক ভালো। তাই স্থানীয়ভাবে চাল সংগ্রহের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ধান-চাল সংগ্রহের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ন্যূনপক্ষে ১০ লাখ টনে উন্নীত করা উচিত। সেই সঙ্গে আমদানির পরিমাণ সীমিত রাখা উচিত। বাজারে চালের দামে স্থিরতা বজায় রাখার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভালো উৎপাদন। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ পর্যাপ্ত হলে ব্যবসায়ীদের কারসাজি করে দাম বাড়ানোর তেমন সুযোগ থাকে না। কিন্তু আমদানি বাড়িয়ে বাজার স্থির রাখার প্রয়াস প্রায়ই ব্যর্থ হয়। অতীতে শুল্ক ও ভ্যাট হ্রাসের মাধ্যমে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি চাল আমদানি করেও বাজারের উচ্চমূল্যে ইতিবাচক সাড়া মেলানো সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। এতে কেবল ব্যবসায়ীদের মুনাফা বৃদ্ধি পায়।
আমন ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০ নভেম্বর থেকে। চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত। গত বোরো মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জিত হয়েছে। এবারও তা অর্জন সম্ভব হবে। মাঠে উৎপাদন ভালো হলে কৃষিপণ্য সংগ্রহের পরিকল্পনা সফল হয়। নতুবা তা ব্যর্থ হয়। গত বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন ছিল রেকর্ড পরিমাণ দুই কোটি ১৩ লাখ টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চাল আমদানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন। ফলে এ নাগাদ অভ্যন্তরীণ বাজারে চাল সরবরাহের কোনো কমতি ছিল না। তা সত্ত্বেও দাম বেড়েছে। মোটা চাল কেজিতে ৬০ টাকা, মাঝারি চাল ৭০ টাকা এবং চিকন চাল ৯০ টাকা ছুঁয়ে গেছে। এ সময় সারা পৃথিবীতে চাল, গম ও ভুট্টার দাম হ্রাস পেয়েছে। ওই বিশ্ববাজার থেকে পর্যাপ্ত আমদানির পরও বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়েনি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আউশ ধানের মৌসুমে চাল উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৩২ লাখ টন এবং চলতি আমনের সম্ভাব্য উৎপাদন প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টন হবে বলে নিশ্চিত করছে কৃষি সাম্প্রসারণ বিভাগ। আগামী বোরো মৌসুমে উৎপাদন ভালো হলে দেশে চালের কোনো ঘাটতি হবে না। এই প্রেক্ষাপটে সরকারি বাজেটে ৯ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। বেসরকারি পর্যায়ে এরই মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এরপর আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে আরো এক লাখ টন। আরো পাঁচ লাখ টন আমদানির পরিকল্পনা আছে। আগামী বোরো ধানের পূর্বাভাস অবলোকন না করে এরূপ চাল আমদানিকে নিরুৎসাহ করাই যুক্তিসংগত হবে। সামনের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে। চাল আমদানির বিষয়টি তাদের পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ থাকা উচিত।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ

























