এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে পরিচালিত গত মে ও জুন মাসের আমদানি ব্যয়ের বকেয়া আগামী সপ্তাহে পরিশোধ করবে বাংলাদেশ। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন বা আকুর এবারের বিলের পরিমাণ ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার। গত ৩ বছরের মধ্যে সংস্থাটির মাধ্যমে পরিশোধ হওয়া এটিই সর্বোচ্চ বিল। এর আগে ২০২২ সালের জুলাই মাসে মে-জুন সময়ের আমদানির বিপরীতে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার আকুর বিল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল। এ বিল পরিশোধ হলে দেশের গ্রস রিজার্ভ আবারও ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাবে, যা অর্থনীতিতে গতি ফেরার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, আগামী ৮ জুলাইয়ের মধ্যে আকুর বিল পরিশোধ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এটার পরিমাণ কত, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন বা আকু হলো তেহরানভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান, যা ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা—এ ৯টি দেশের মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তিতে কাজ করে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গতকাল বুধবার
পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। আগামী সপ্তাহে আকুর বিল পরিশোধ হওয়ার পর গ্রস রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ২৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। তবে বিল পরিশোধ হলেও দেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভে কোনো পরিবর্তন আসবে না। বর্তমানে দেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ বা এনআইআরের পরিমাণ ২০ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
কেন আকু বিল পরিশোধের পরও এনআইআরে প্রভাব পড়বে না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী এক বছরের মধ্যে কি পরিমাণ বিল পরিশোধ করবে, তা রিজার্ভ থেকে বাদ দেওয়ার পরই নিট রিজার্ভ হিসাব করা হয়। এ জন্য আকুসহ অন্যান্য বিল পরিশোধে নিট রিজার্ভে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসে না। তবে রিজার্ভ থেকে যদি ডলার বিক্রি হয় বা সরকার তার কোনো প্রজেক্টে ডলারে বিনিয়োগ বা ঋণ দেয় তাহলেই নিট রিজার্ভে প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ প্রতি দুই মাস অন্তর আকুর বিল পরিশোধ করে থাকে। সর্বশেষ ৬ মে- মার্চ ও এপ্রিল মাসের আমদানির জন্য ১ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল, যার ফলে বিপিএম৬ অনুযায়ী রিজার্ভ নেমে গিয়েছিল ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। তবে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণের অর্থ ডলারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া রিজার্ভ প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এ জন্য আকুর বিল পরিশোধের পরও বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ থাকবে ২৪ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত এ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর থেকে বিল পরিশোধের পরিমাণ ওঠানামা করলেও ২০২৩ সালের পুরো বছরজুড়ে প্রতি দুই মাস অন্তর পরিশোধ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের নিচেই ছিল। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে আবার পেমেন্টের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। সর্বশেষ মে-জুন মাসে তা তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
ব্যাংকাররা আমদানির এ ঊর্ধ্বগতিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তারা বলছেন, এটি ব্যাংকিং খাতে ভালো বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ২০২২ সালের আগেও প্রতি মাসে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলার আকুকে পেমেন্ট করতে হতো। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করায় পরিমাণটি কমতে শুরু করে। সেই সঙ্গে আকু সদস্য দেশগুলো থেকে আমদানিও হ্রাস পাওয়ায় পেমেন্ট কমে যায়।
তিনি বলেন, ‘ফরেক্স রিজার্ভে স্থিতিশীলতা আসা এবং বিনিময় হার কম ওঠানামা করায় আমদানি আবার বাড়তে শুরু করেছে। এর ফলে আকু দেশগুলো থেকেও আমদানি বেড়েছে, যার কারণে আকুর পেমেন্টও বেড়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে ভোক্তা পণ্য, শিল্পের কাঁচামালসহ অন্যান্য আমদানি বেড়েছে। তবে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে ২৬ শতাংশ এবং মধ্যবর্তী পণ্য ও পেট্রোলিয়াম আমদানিও হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে এলসি খোলা হয়েছে ৭০ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এলসি খোলা হয়েছিল ৬৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে এলসি খোলা বেড়েছে ১ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এলসি খোলা হয়েছে ৬৬ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগের তুলনায় বেড়েছিল ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি কালবেলাকে বলেন, আকুর ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলারের বিল অর্থনীতিতে গতির ইঙ্গিত দেয়। এর মানে হলো—আমদানি বাড়ছে, বিশেষ করে ভোক্তা পণ্য ও শিল্প কাঁচামাল, যা উৎপাদন ও রপ্তানিতে সহায়ক। বিল পরিশোধের পরও নিট রিজার্ভে তেমন প্রভাব পড়বে না, যা ভালো দিক। বাংলাদেশ ব্যাংক আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়ায় রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। এলসি খোলা বেড়েছে, যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতার লক্ষণ। তবে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমে যাওয়াটা চিন্তার বিষয়, কারণ তা ভবিষ্যতের বিনিয়োগে প্রভাব ফেলতে পারে। সব মিলিয়ে, আকুর বড় বিল একদিকে যেমন অর্থনৈতিক গতি ফেরার ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে আমদানি কাঠামোর ভারসাম্য রক্ষাও এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।