অসাধু কিছু পেট্রল পাম্প কর্মচারী ও মালিকের যোগসাজশে দুর্মূল্যের এই বাজারেও কষ্টার্জিত টাকায় কেনা তেল পরিমাণে পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। বিভিন্ন পেট্রল পাম্পে সুক্ষ কারসাজির মাধ্যমে অর্ডারের তুলনায় গ্রাহককে দেওয়া হচ্ছে কম তেল। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একের পর এক অভিযানেও থামানো যাচ্ছে না জালিয়াতি। তবে পুরো দাম নিয়েও পরিমাণে কম তেল (অকটেন) দেওয়ায় এবার খোদ রাজধানীতে প্রতিবাদের আওয়াজ তুলেছেন শেখ ইশতিয়াক নামে এক ব্যাংককর্মী। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ওই পাম্পে গতকাল সোমবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অবস্থান করে প্রতিবাদ জানান ইস্টার্ন ব্যাংকে কর্মরত শেখ ইশতিয়াক। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দক্ষিণ কল্যাণপুর এলাকায় অবস্থিত সোহরাব সার্ভিস স্টেশনে এ ঘটনা ঘটে।
ইশতিয়াকের মৌখিক অভিযোগ গ্রহণ করে আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে শুনানির পর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে বিকাল ৫টার দিকে প্রতিবাদ স্থগিত করে পাম্প ছাড়েন ইশতিয়াক।
গতকাল শেখ ইশতিয়াক আমাদের সময়কে জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সোহরাব সার্ভিস স্টেশনে গিয়ে বাইকের জন্যে ৫০০ টাকার অকটেন নেন। কিন্তু পাম্প থেকে ৫০০ টাকার ভাউচার দেওয়া হলেও ওই পরিমাণ তেল তাকে দেওয়া হয়নি বলে তার ধারণা হয়। ৫০০ টাকার স্থলে তাকে ৩০০ টাকার তেল দেওয়া হয়েছে অভিযোগ তুলে তিনি মোটরসাইকেল থেকে তেল বের করে মাপার কথা বললেও পাম্প কর্তৃপক্ষ তাতে সাড়া দেয়নি। এর প্রতিবাদে তিনি একটি সাদা কাগজে ‘সঠিক পরিমাণে তেল চাই’ লিখে ওই পাম্পের সামনেই অবস্থান নেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় দারুস সালাম থানা পুলিশের একটি দল।
ওই ব্যাংকার বলেন, অভিযোগের বিষয়ে কাউন্টারে জানালে প্রথমে কর্তৃপক্ষ আমাকে পাত্তা-ই দেয়নি। খবর পেয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা একে একে ঘটনাস্থলে আসতে থাকলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। আমি পাম্প কর্তৃপক্ষকে বলি, আমি ৫০০ টাকা দিয়েছি, পুরো টাকার তেল বুঝিয়ে দেন। একপর্যায়ে তারা ভুল হয়েছে স্বীকার করে বাইকে আরও তেল ঢুকাতে চায়। যেহেতু পুরো বিষয়টি পাম্পের লোকজনের ভুল নয়, সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে তারা এমনটা করেছে এবং সবাইকে এভাবে ঠকাচ্ছে তাই আমি প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নিই। পুলিশ আসার পরও পাম্প কর্তৃপক্ষ আমার কাছে বারবার ক্ষমা চায়। অন্যায়ের এভাবেই প্রতিবাদ জানিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই বলে থানায় কোনো অভিযোগ করিনি। তবে বিষয়টি আমি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক পরিচালককে ফোনের মাধ্যমে অভিযোগ আকারে জানাই। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে পুরো বিষয়টি আমার কাছ থেকে শুনে কাল একটি লিখিত অভিযোগ অধিদপ্তরে জমা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে আসবেন বলে জানান।
সকালে এলে পাম্প কর্তৃপক্ষ রাতেই চুরির নথিপত্র সবার অজান্তে ঠিক করে রাখবে; তখন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া কষ্টকর হতে পারে বলে ওই কর্মকর্তাকে জানান ইশতিয়াক। জবাবে ওই কর্মকর্তা প্রশ্ন করেন- পাম্প কর্তৃপক্ষ কি আপনার কাছে ভুল স্বীকার করেছে? হ্যাঁ, বলতেই তিনি আমার মৌখিক অভিযোগ লিখে রাখেন ও মঙ্গলবার বিষয়টি নিয়ে তিনি বসবেন বলে জানান। মঙ্গলবার ডাকা হলে ঘটনাস্থলে আসার অনুরোধ জানিয়ে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, উভয়পক্ষের কথা শুনে অভিযোগের সত্যতা পেলে দায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তার এই আশ্বাসের ভিত্তিতে আমি বিকালে প্রতিবাদ স্থগিত করে পাম্প এলাকা ছাড়ি। এখন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিচারে কী হয়, সেই অপেক্ষায় রয়েছি। মঙ্গলবার অধিদপ্তর কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান, অভিযোগকারীকে বলা হয়েছে, তিনি যেন অফিসে এসে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগ পাওয়ার পর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোনো ভোক্তা প্রতারিত হলে সঠিক পন্থায় এসে অভিযোগ দিলে তার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় ঘটবে না।
ব্যাংককর্মী ইশতিয়াকের অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল একাধিকবার সোহরাব সার্ভিস স্টেশনের নির্ধারিত নম্বরে ফোন করা হলেও ওপাশ থেকে কেউ সাড়া দেয়নি। পরে ওই পাম্পে গেলে উপস্থিত কেউই অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
এদিকে তেল চুরির বিষয়ে বিভিন্ন তেলের পাম্পে কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। কয়েকটি পাম্পের কর্মীরা জানান, মূলত পাঁচ উপায়ে তেল চুরি করে গ্রাহকদের পকেট কাটা হয়। যেমন- অনেক পাম্পে গ্রাহক ২০০ টাকার তেল চান। কর্মীরা তাকে ২০০ টাকার তেল দিয়ে মিটারের রিডিংয়ে ২০০ টাকাই রেখে দেন। পরবর্তীতে কেউ পাঁচশ টাকার তেল নিতে আসলে অসাধু সেই কর্মীরা রিডিং শূন্য না করে সেই দুইশ টাকা থেকেই তেল দেওয়া শুরু করেন। এতে করে ওই গ্রাহক ৩০০ টাকার তেল পান। কিন্তু মেশিনে বিল আসে ৫০০ টাকার।
গ্রাহকরা অন্যমনস্ক থাকায় তারা এই জালিয়াতি ধরতে পারেন না। কখনো এমন অবস্থায় পড়লে, প্রতারণা এড়াতে পাম্পের কর্মীদের মিটার শূন্য করে ফের বাকি টাকার তেল দেওয়া শুরু করতে বলতে হবে। আবার অনেক অসাধু পেট্রল পাম্প মালিক প্রয়োজনের তুলনায় অনেক লম্বা পাইপ ব্যবহার করে থাকেন তেল ভরার জন্য। তেল ভরার সময়, নিখুঁত মিটার রিডিংকেও ফাঁকি দিয়ে ক্রেতাকে কম তেল দিয়ে ঠকানো হচ্ছে। কারণ মিটারে যদি দেখায় যে, ১ লিটার তেল দেওয়া হয়ে গিয়েছে সে ক্ষেত্রে তখনো বেশ কিছুটা তেল ওই লম্বা পাইপেই থেকে যায়। ১ লিটারে ৫০-৬০ মিলিলিটার তেল কম দিলে কেউ খেয়ালও করে না। এভাবে সারাদিনে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত শত লিটার চুরি করছে পেট্রল পাম্প কর্তৃপক্ষ।
সুইচ অন অফ করেও করা হচ্ছে প্রতারণা। যদি দেখা যায়, পাম্প কর্মচারী বারবার তেলের পাইপের সুইচ নামিয়ে ফেলছেন, তাহলে বুঝতে হবে কারসাজি করা হচ্ছে। বারবার অফ হয়ে যাওয়ার ফলে ন্যায্য মূল্যের তেল পাবেন না গ্রাহক। মিটার রিডিংয়ে এসব কারচুপি খুব একটা ধরা পড়ে না। তাই তেল নেওয়ার সময় কর্মচারীকে বলতে হবে, তিনি যেন ট্যাংকে পাইপ ঢোকানোর সময়েই ফিলিং পাইপ অন করেন।
আবার পেট্রলের সঙ্গে ন্যাপথা (পেট্রলেরই উপজাত দ্রব্য) মেশানোর মাধ্যমেই হচ্ছে সীমাহীন চুরি। যেমন- কিছু অসাধু পেট্রল পাম্পমালিক অনেক ক্ষেত্রে পেট্রলের সঙ্গে ন্যাপথা মিশিয়ে ক্রেতাকে ভেজাল তেল দিয়ে ঠকান। ন্যাপথা আর পেট্রলের ঘনত্ব একই রকম হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই কারসাজি ধরা পড়ে না। পাম্পে ডিজিটাল চিপের মাধ্যমেও অনেক সময় চুরি করা হচ্ছে গ্রাহকের তেল। এ চিপটি রিমোট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পাম্পে একজন লোক থাকে যিনি রিমোট দিয়ে চিপ নিয়ন্ত্রণ করেন। কোনো পাম্প থেকে তেল নেওয়ার পর যদি মনে হয় মিটারে ঝামেলা আছে তাহলে ১ লিটারের বোতলে তেলটি মেপে দেখলেই বিষয়টি খোলাসা হয়ে যাবে বলেও জানান তারা।