পৃথিবীরে অন্যতম বায়ুদূষণের শিকার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। কোনোভাবেই এই দূষণ থামানো যাচ্ছে না।প্রায়ই একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) অনুযায়ী দূষণের তালিকায় শীর্ষে চলে আসছে এই শহর। এমন সময় আলোচনা উঠেছে রাজধানী দিল্লি থেকে সরিয়ে অন্যকোথাও করা যায় কি না।
আর এই প্রস্তাব প্রথম দিয়েছেন দেশটির অন্যতম প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ শশী থারুর। তিনি ভারতের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের একজন, জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও দেশের প্রাক্তন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, জনপ্রিয় লেখক ও চিন্তাবিদ। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার দেওয়া প্রস্তাবটা নিয়ে ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় উঠেছে।
দুদিন আগে নিজের ভেরিফায়েড এক্স হ্যান্ডল থেকে শশী থারুর পোস্ট করেন, “পুরো নভেম্বর থেকে মার্চ মাস যে শহরটা কার্যত বাসযোগ্য থাকে না, আর বছরের বাকি সময়টাও কোনও রকমে টিকে থাকা যায়– সেই শহরটার আদৌ কি দেশের রাজধানী থাকা উচিত?”
তিনি আসলে দিল্লির শীতে তীব্র দূষণের কথাই বলেছেন। যেদিন তিনি এই টুইট করেন (১৮ নভেম্বর, সোমবার), সেটা ছিল দিল্লির ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষিত দিন। শহরের গড় একিউআই সে দিন ছিল ৪৯৪, যা ‘বিপজ্জনক’ মাত্রার চেয়েও চার-পাঁচগুণ বেশি।
পরদিন সকালে দিল্লির প্রভাতী খবরের কাগজগুলোর প্রধান শিরোনাম ছিল অনেকটা এরকম : দ্য হিন্দুস্থান টাইমস লিখেছিল ‘ম্যাক্সিমাম টক্সি-সিটি’, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ভাষ্য ছিল ‘দিল্লি ব্রিদস পয়সন’ (দিল্লি বিষ-শ্বাস নিচ্ছে) আর টাইমস অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছিল যবে থেকে আবহাওয়ার রেকর্ড রাখা হচ্ছে, তার মধ্যে দিল্লিতে এর চেয়ে খারাপ দিন মাত্র একবারই এসেছে!
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এরকম একটা শহর আসলেই ভারতের রাজধানী হওয়ার যোগ্য কি না– কিংবা শীতে দেশের রাজধানী অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়াটা সমীচীন কি না– সেই প্রশ্নটা ওঠা তাই অস্বাভাবিক নয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শীত পড়তে না পড়তেই যে শহরটা পুরু কালো ধোঁয়াশা বা ‘স্মগে’র আস্তরণে ছেয়ে যায়, বাস-ট্রেন-গাড়ি-বিমানের চলাচল লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, কয়েক কোটি দিল্লিবাসী খুসখুসে কাশি আর নাকমুখ জ্বালা জ্বালা করার উপসর্গে ভুগতে শুরু করেন এবং ভারতের রাজধানী প্রায় নিয়ম করে বিশ্বের দূষিততম শহরের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে থাকে– সেখানে এই বিতর্কটাঅনেক আগেই শুরু হওয়া উচিত ছিল।
শশী থারুর কেরালার তিরুবনন্তপুরম থেকে টানা চারবারের নির্বাচিত কংগ্রেস এমপি, এবং দক্ষিণ ভারতের একজন সাংসদ একথা বলছেন বলেই কি না কে জানে– অনেকেই তার প্রস্তাব লুফে নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন, ভারতের রাজধানীটা বরং চেন্নাই বা হায়দ্রাবাদের মতো দক্ষিণের কোনও শহরেই সরানো উচিত হবে। যথারীতি এর বিরোধিতাও আছে প্রবল, দিল্লির যতই সমস্যা থাক– বিশেষত উত্তর ভারতীয়রা অনেকেই চান না দিল্লি থেকে রাজধানী সরানোর ভাবনা এমনকি আলোচনাতেও আসুক!
তবে দূষণের কারণে কোনও দেশে রাজধানী সরানোর প্রস্তাব এটাই প্রথম নয়– বস্তুত পৃথিবীর একটি অন্যতম জনবহুল দেশ তো বিভিন্ন পরিবেশগত কারণে তাদের রাজধানী প্রায় ১০০০ কিলোমিটার দূরে নতুন একটি শহরে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে।
এ সপ্তাহে দিল্লির দূষণ নিয়ে বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়েছে, দিল্লির এই মারাত্মক স্মগে বেঁচে থাকাটাই যেন একটা ‘ডিসটোপিয়ান’ সিনেমা বারবার দেখে যাওয়ার মতো বিষয়। ডিসটোপিয়া বলতে বোঝায় দুর্দশা, আতঙ্ক বা অবিচারের একটা কাল্পনিক জগৎ- কিন্তু দিল্লিবাসীর জীবনে সেই দুঃস্বপ্নই যেন বছরের পর বছর ধরে বারবার সত্যি হয়ে ফিরে আসছে।
প্রতিবার নভেম্বর এলেই দিল্লিতে এই মারাত্মক সমস্যা শুরু হয়ে যায়, কীভাবে এর প্রতিকার সম্ভব তা নিয়ে দিস্তে দিস্তে লেখালেখি আর তুমুল তর্কবিতর্ক হতে থাকে, রাজনীতিবিদরা পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকেন– কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কোনও সমাধান বের হয় না!
গত কয়েক বছরে দিল্লি দূষণের মোকাবিলায় এক দিন জোড়, আর অন্য দিন বেজোড় নম্বরের গাড়ি চালানোর এক্সপেরিমেন্ট করেছে, শহরের বড় বড় ব্যস্ত মোড়ে ‘ক্লিন এয়ারে’র মেশিন বসিয়েছে, পার্শ্ববর্তী রাজ্য পাঞ্জাব বা হরিয়ানার কৃষকদের ফসলের গোড়া জ্বালানো থেকে নিরস্ত করতে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। দু’দিন আগে দিল্লির আম আদমি পার্টি সরকার তো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ‘ক্লাউড সিড’ করে রাজধানীতে কৃত্রিম বৃষ্টি ঘটানোরও অনুমতি চেয়েছে, যদিও তাদের কাছে সেই প্রযুক্তি আদৌ আছে কি না সেটাই স্পষ্ট নয়। তবে বাস্তবতা হলো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও কিছুতেই কিছু হয়নি– প্রতি বছরই দিল্লিতে দূষণ আবার ফিরে এসেছে।