ভাঙতে ভাঙতে স্বামীর ভিডা তো গ্যাছে হেই বছর পাঁচেক আগে, আর এহন গেলো বাপের ভিডা। হ্যার পরো মোগো দিগ কেউ ফিইর্যা চায়না, চাইয়্যাও বা- কি অইবে কোন কিছুতেই তো ঠ্যাক মানে না।
মোগো জীবন লইয়া মোগোই যুদ্ধ করোন লাগবো। কালাবদর নদীর গ্রাসের অপেক্ষায় থাকা বাবার বাড়ির শেষ হাতখানেক জমির ওপর দাঁড়িয়ে এসব কথা বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ ফাতেমা বেগম।
তিনি জানান, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামে তার স্বামীর পৈতৃক ভিটা ছিল। সেই মোল্লাবাড়িতে স্বজনদের সবার সাথে ৩০-৩৫ বছর ধরে মিলে মিশে বসবাস করেছেন।
কিন্তু ৫ বছর আগে সেই ভিটা কালাবদর নদী গ্রাস করে নেওয়ায় এখন যে যার মতো করে সুবিধাজনক স্থানে নতুন করে বসতি গড়েছেন। অথচ ভাঙনের কয়েক বছর আগেও নদী এত দূরে ছিল যে ভাবতেই পারেননি বেঁচে থাকতে নিঃস্ব হওয়ার কথা। তারপরও সংগ্রামী জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শ্রীপুরের মহিষমাড়ি এলাকায় আবার জমি কিনে ঘর করেছেন ফাতেমার পরিবার।
ফাতেমা বলেন, শুধু শ্বশুরবাড়ির নিয়াই খ্যান্ত হয়নাই, এবার চর ফেনুয়ার বাপের ভিডাও লইয়্যা গেলো কালাবদর। এহন যা আছে হ্যাতে খালি খাড়াইয়া-ই থাহা যায়।
ফাতেমার এসব কথা শুনতে শুনতে তার স্বামী রশিদ মোল্লা বলে উঠলেন- এগুলা এহন সইয়্যা গেছে, আর আপনারা হুইন্যাও বা কি করবেন, আমাগো ভাগ্য ফেরবে না।
৬৫ বছরের রশিদ মোল্লা শ্বশুরবাড়ির জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা শেষ নারিকেল গাছটিতে কুড়াল দিয়ে আঘাত (কোপ) করতে করতে বলেন, নদীতে সব গেলেও বাইচ্যা তো থাকতে হইবে, তাই ধার-দেনা কইর্যা ঘর উঠাইছি, পোলাপানের সহযোগিতায় নতুন ঘর করছি। এহন দেহি কবে থামে এই ভাঙন।
মাঝ নদীর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, মাঝ নদীর যেহান দিয়া ফেরিডা যাইতে আছে, হেই হানে ছিল মোগো মোল্লা বাড়ি। হ্যার পর প্রত্যেক বছরে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এহন আইয়া হাওলাদার বাড়ি (শশুর বাড়ি)ও ভাইঙ্গা গেলো। আর এই নদী ভাঙনই মোগো দুই বাড়ির সবাইরে আলাদ কইরা দিলো। যে যার মতো করে নানান জায়গায় গিয়া থাকতাছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ইকবাল জানান, শুধু গেল বছর আর এ বছরের ভাঙনে তাদের সিকাদর বাড়ির ২৮টি ঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন একটা পুকুর টিকে আছে, যাও দুই-একদিনের মধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।
ইকবাল বলেন, মেহেন্দিগঞ্জের শ্রীপুরের মানুষ গত কয়েক বছর ধরে শুধু নদী ভাঙনের কারণে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। নদীতে বিলীন হওয়ার পর নতুন করে সবকিছু গড়তে ধার-দেনায় জর্জরিত হচ্ছে।
ভাঙন ঠেকানো না গেলে এ থেকে উত্তরণও হবে না। আর ভাঙন ঠেকবেও বা- কি করে ভাঙন রক্ষায় যে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল, তা নদী গ্রাস করে নিয়ে নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে।
আবার চরের মাঝে খাল কেটে স্রোতের চাপ কমাতে গিয়ে, এখন সেই চরই বিলীন হয়ে নদীর মুখই বড় হয়ে গেছে। কোনোকিছুতেই নদীর ভাঙন ঠেকানো যায়নি, ভাগ্যসহ আমাদের সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে।
শ্রীপুরের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী নাজমুস সাকিব জানান, গেলো দুইমাসে কালাবদর আর তেতুলিয়া নদীর সংযোগস্থলে ভাঙনে গেল দুইমাসে শ্রীপুর ইউনিয়নের দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকার একটি মসজিদ ও মাদ্রাসাসহ ৬০-৭০টি বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে।
ভাঙন রোধে নদী তীরে যে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল তাও ভাঙনে চলে গেছে। প্রচণ্ড ভাঙনে দিশেহারা হয়ে নদী তীরের মানুষ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।
এখনও যাদের জায়গা জমি টিকে আছে তারাও ভাঙনের শঙ্কা নির্ঘুম রাত পার করছেন, আর ভাঙন রোধে সৃষ্টিকর্তার কাছে সহযোগিতা কামনা করছেন।