বাংলাদেশে ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে বিধিনিষেধের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার সাংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোন দেশে সেন্ট্রাল ব্যাংকে সাংবাদিকেরা অবাধে ঢুকতে পারছেন? সব ওয়েবসাইটে আছে, আপনার জানার বিষয়। আপনি ভেতরে ঢুকবেন কেন?’
একই অনুষ্ঠানে সেতুমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান, ‘দেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসায় সরকার উদ্বিগ্ন কি না।’ জবাবে তিনি বলেন, ‘কে বলল আপনাকে ১৩ বিলিয়ন ডলার? কোন নিউজে বলছে আপনাকে? আমাদের কাছে হিসাব আছে।’
এ সময় সাংবাদিকেরা তাঁকে জানান, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, ব্যবহার করার মতো ১৩ বিলিয়ন ডলার আছে।’ এ তথ্যের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘তাহলে গভর্নরকে জিজ্ঞাসা করুন—কী কারণে এটা এ পর্যায়ে এল? আমরা তো এটা জানি না। আমরা জানি, ১৯ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক একদিকে বললেন, সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকবেন কেন, অন্যদিকে রিজার্ভের তথ্য যাচাই করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকেই জিজ্ঞাসা করতে বললেন। যদি তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতেই না পারেন, কীভাবে গভর্নরকে জিজ্ঞাসা করবেন? ই-মেইল পাঠিয়ে? টেলিফোন করে? তিনি যে ই-মেইলের জবাব দেবেন কিংবা টেলিফোন ধরবেন, তার নিশ্চয়তা কী।
সাংবাদিকেরা অবাধে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করার কথা বলেননি। তাঁরা বলেছেন, এত দিন বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশের যে নিয়ম চালু রেখেছিল, সেটাই বহাল রাখা হোক। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সব ভবনের নিচতলায় অভ্যর্থনা বিভাগে রাখা রেজিস্ট্রার বইয়ে পরিচয় লিখে সই করে বিশেষ ‘পাস’ নিয়ে সাংবাদিকেরা ভেতরে যেতে পারতেন। অস্থায়ী এ পাস বের হওয়ার সময় ফেরত দিতে হতো। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ রীতির চর্চা ছিল।
কিন্তু মাসখানেক আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে সাংবাদিকেরা ব্যাংকের অস্থায়ী পাস নিয়ে শুধু মুখপাত্রের কাছে যেতে পারবেন। কোনো কর্মকর্তা যদি সাংবাদিকদের পাস দেন, সে ক্ষেত্রে তাঁরা শুধু সেই কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন। আগের মতো সাংবাদিকেরা অবাধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো বিভাগে প্রবেশ করতে পারবেন না।’
সাংবাদিকেরা কখনোই অবাধে বাংলাদেশ ব্যাংকে যেতেন না। তাঁরা অস্থায়ী পাস নিয়ে যেতেন। তাঁরা তথ্য প্রাপ্তি বা যাচাইয়ের জন্য যাঁদের সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করতেন। কথা বলতেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ঠিক করে দিতেই চাইছে, সাংবাদিকেরা কার সঙ্গে দেখা করবেন, সেটাও আগে বলতে হবে, তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা বলেছেন। কিন্তু সেসব দেশে তো ঋণখেলাপিরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেন না। ইচ্ছেমতো আইন বদলে দিতে পারেন না। সেসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেসব ওয়েবসাইটে জানিয়ে দেয়। আমাদের এখানে দেওয়া হয় না। বরং অনেক তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়।
সচিবালয়েও এই মাত্রার কড়াকড়ি নেই। অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড থাকলে সচিবালয়ে ঢুকে সাংবাদিক যাঁর সঙ্গে প্রয়োজন দেখা করতে পারেন। অবশ্য সেটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে। বাংলাদেশ ব্যাংকেও সাংবাদিক যাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, তিনি অনুমতি না দিলে তো কথা বলতে পারবেন না। তাহলে নতুন নিয়ম কেন?
বাংলাদেশ ব্যাংক এই অলিখিত আদেশ এমন সময়ে জারি করল, যখন ব্যাংক একীভূতকরণ ও খেলাপি ঋণ নিয়ে নানা রকম খবর সংবাদমাধ্যমে আসল। বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ব্যাংক একীভূত করার কথা বলেছে, তাদের মধ্যে কোনো কোনোটি আপত্তি করেছে। সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকের একীভূতকরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাংবাদিকেরা এসব নিয়ে খবর করার কারণেই যদি নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়ে থাকে, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংক খাতের ‘রোগ’ সারাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পথনকশা ঘোষণা করেছিল, সব সংবাদমাধ্যমই তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছে। ব্যাংকিং খাতের সমস্যা অনেক পুরোনো হলেও আগের কোনো গভর্নর এ ধরনের পদক্ষেপ নেননি। বর্তমান গভর্নর নিয়েছেন।
পথনকশায় ১৭টি বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, খেলাপি ঋণ কমানো, বেনামি ঋণ ও জালিয়াতি বন্ধ করা, যোগ্য পরিচালক নিয়োগে ব্যবস্থা, উপযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ এবং দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তাদের লক্ষ্য তিনটি—১. ব্যাংকের সার্বিক খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামানো, যা এখন ১০ শতাংশের একটু কম। ২. রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, যা এখন যথাক্রমে প্রায় ২২ ও ৭ শতাংশ। ৩. ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য সীমার বাইরে দেওয়া ঋণ, বেনামি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ এবং জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শূন্যে নামিয়ে আনা।
উল্লেখ্য ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার মতো, যা এখন ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পথনকশাকে ইতিবাচকভাবেই দেখেছে সংবাদমাধ্যমগুলো। তাহলে সাংবাদিকদের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার যুক্তি থাকতে পারে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজের মধ্যে আছে মুদ্রানীতি ও ঋণনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ এবং দেশীয় আর্থিক বাজারের প্রসার ও উন্নয়ন; দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা; মুদ্রা (ধাতব ও কাগুজে মুদ্রা) ইস্যু করা; পরিশোধব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান ইত্যাদি।
এই কাজগুলো যদি জনগণ ও দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হয়, তবে সাংবাদিকদের অধিকার আছে সে সম্পর্কিত তথ্যাবলি জনগণকে জানানো। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক তার ওয়েবসাইটে সব তথ্য দিয়ে দেবে, এটা আশা করা যায় না। যেসব দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজে শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকে, সেসব দেশে জানিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও সাংবাদিকদের কাজ হলো অজানা তথ্যগুলোই দেশবাসীকে জানানো।
বর্তমান সরকার কিংবা পূর্ববর্তী সরকারের আমলে যেসব ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তার কোনোটি ওয়েবসাইটে কোনো কর্তৃপক্ষ দেয়নি। সাংবাদিকেরা নানা কৌশলে বের করেছেন এবং পাঠক ও দর্শকদের জানিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে।
সাংবাদিকেরা বিভিন্ন সূত্র থেকে আর্থিক খাতের তথ্য পান, সেগুলোর সত্যতা যাচাই করার জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেতে হয়। তাঁদের এই যাওয়ার মধ্যে চক্রান্ত খুঁজলে কিংবা তথ্য চেপে রাখার চেষ্টা হলে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্যও কল্যাণকর নয়।
সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক কিংবা আধা গণতান্ত্রিক শাসন—সব আমলেই সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ ব্যাংকে যেভাবে প্রবেশের সুযোগ পেতেন, সেটাই তাঁরা চাইছেন, এর বেশি কিছু নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে সাংবাদিকদের বরাবর সহযোগিতা করে এসেছে। কোনো সমস্যা হয়নি। এই কলাম লেখকও একজন সাবেক গভর্নরের আগ্রহে দুবার বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা বলেছেন। কিন্তু সেসব দেশে তো ঋণখেলাপিরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেন না। ইচ্ছেমতো আইন বদলে দিতে পারেন না। সেসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেসব ওয়েবসাইটে জানিয়ে দেয়। আমাদের এখানে দেওয়া হয় না। বরং অনেক তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়।
আমাদের এখানে ঋণখেলাপিরা সুদের হার ও পরিচালকদের মেয়াদ ঠিক করে দেন। দেউলিয়া অবস্থা থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংককে রক্ষা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধার দিয়ে টিকিয়ে রাখে, যার নজির কোথাও নেই। সব চলবে বাংলাদেশের নিয়মে, শুধু সাংবাদিকদের জন্য প্রয়োগ হবে বিদেশি নিয়ম!
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন বিধিনিষেধের প্রতিবাদ করেছেন সাংবাদিকেরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বিধিনিষেধের প্রতিবাদে একবার সংবাদ সম্মেলনও বর্জন করেছেন তাঁরা। কিন্তু কাজ হয়নি। সম্প্রতি তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতও আশ্বাস দিয়েছিলেন, সমস্যাটির শিগগিরই সুরাহা হবে। এরই মধ্যে নতুন করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য শোনা গেল; ‘সব ওয়েবসাইটে আছে আপনার জানার বিষয়। আপনি ভেতরে ঢুকবেন কেন?’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হ্যাকাররা সুইফট-ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে ভুয়া বার্তার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের নিউইয়র্ক শাখায় রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল এবং তারা যথাসময়ে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকেরা যদি এখন সেই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চান, সেটাও তাঁদের অনধিকার চর্চা হবে?
ওবায়দুল কাদের সাহেব একসময় সাংবাদিকতা করতেন। কলাম লিখে জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। সে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এ রকম বিধিনিষেধ জারি করলে তিনি কি তা সমর্থন করে কলাম লিখতেন?
তাঁর বিবেকের কাছেই এ প্রশ্ন রাখলাম।