আমাদের দেশের শতকরা ২০ ভাগ মানুষ থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগছেন। এই হরমোনের ঘাটতি কিংবা আধিক্যের কারণে ব্যাপক শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন কারণে থাইরয়েড গ্রন্থি আক্রান্ত ও এর কার্যক্রম বিঘিœত হয়। এর মধ্যে আয়োডিনের ঘাটতি কিংবা আধিক্য, বিভিন্ন ভাইরাসের আক্রমণ, অটোইমিউন রোগ, বিভিন্ন ওষুধের প্রতিক্রিয়া, জন্মগত ত্রুটি, গর্ভ-পরবর্তী অবস্থা অন্যতম প্রধান কারণ। মোটা দাগে থাইরয়েডের সমস্যাগুলো হচ্ছে হরমোনের ঘাটতি বা হাইপো থাইরয়েডিজম হরমোনের আধিক্য বা হাইপার থাইরয়েডিজম, প্রদাহ কিংবা থাইরয়েডাইটিস, গলগ- ও ক্যানসার।
হাইপো থাইরয়েডিজম : পৃথিবীতে হরমোনের ঘাটতিজনিত রোগটির আধিক্য বেশি। পুরুষদের তুলনায় নারীরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। হরমোনের ঘাটতি হলে শরীরের নেমে আসে ক্লান্তি, তন্দ্রা ও অবসাদগ্রস্ততা। ঠাণ্ডা সহ্য করার ক্ষমতা কমে যায়। ওজন বাড়তে থাকে। কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। মাসিক হয়ে পড়ে অনিয়মিত। ক্ষেত্রবিশেষে নেমে আসে বন্ধ্যত্ব। হৃৎস্পন্দন কমে যায়। হৃদপেশি কোষ আক্রান্ত হয়ে কার্ডিওমায়োপ্যাথি হতে পারে। চুল পড়তে থাকে। পা, শরীর ও মুখে পানি চলে আসে। এমনকি ফুসফুস ও পেটে পানি আসতে পারে এই রোগে। রক্তে চর্বির মাত্রা বেড়ে যায়। অনেকের লিভারে জমতে থাকে মেদ। বলা হয় ফ্যাটি লিভার। এ রোগে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। অনেকেই আক্রান্ত হন বিষণ্ণতায়। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে ভয়ানক পরিণতি নেমে আসতে পারে রোগীর।
হাইপার থাইরয়েডিজম : হাইপার থাইরয়েডে ওজন কমতে থাকে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। ঘাম নিঃসরণ বেড়ে যায়। হাতের তালু ও পায়ের পাতা ঘামে ভিজে যায়। গরম মনে হয় অসহ্য। জ্বর জ্বর ভাব থাকে। অনেকের দীর্ঘদিনের জ্বরের পেছনে দায়ী হতে পারে এই রোগ। এ রোগে পায়খানা ঘন ঘন হতে থাকে। হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা বেড়ে যায়। রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়। মূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে যায় ক্যালসিয়াম। শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। হাতে কাঁপুনি দেখা দেয়। রোগীরা থাকেন উদ্বিগ্ন। অনেক সময় এ রোগে চোখ কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসতে চায়। বড় হয়ে যায় অক্ষিগোলক। দীর্ঘদিন এই রোগের চিকিৎসা না নিলে মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। হৃৎপি- পর্যন্ত বিকল হয়ে যেতে পারে এই রোগে।
থাইরয়েডাইটিস : থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহের কারণে গলাব্যথা হয় এবং তা ছড়িয়ে যেতে পারে চোয়ালে। জ্বর হয় এ গ্রন্থির প্রদাহে। থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণে গোলযোগ দেখা দেয়। অনেকেরই এমনটি হলে দীর্ঘকালের জন্য দেখা দিতে পারে হরমোন ঘাটতিজনিত রোগ।
গলগ- : গলগণ্ডের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় আয়োডিন ঘাটতির কারণে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দূরে অবস্থিত মাটিতে আয়োডিনের ঘাটতি রয়েছে। ফলে সেখানকার ফসলেও আয়োডিন কম থাকে। আয়োডিনের অভাবে দেখা দেয় গলগণ্ড। এই রোগে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যায়। অনেকেই শুরুতে তেমন পাত্তা দেন না রোগটিকে। কিন্তু কালক্রমে এতটাই ফুলে যায় যে, তখন শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হওয়ার পাশাপাশি কণ্ঠ বদলে যায়।
থাইরয়েড গ্রন্থির ক্যানসার : থাইরয়েড গ্রন্থির ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। শুরুতে ক্যানসারের লক্ষণ দেখা দিতে পারে এ গ্রন্থিটির ওপর ছোট বিচির মতো ফুলে যাওয়ার মাধ্যমে। আমরা বলে থাকি নডিউল। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ নডিউল হতে পারে সাদামাটা। এতে ভয়ের কিছু থাকে না। তবে বয়স, লিঙ্গ, আনুষঙ্গিক অন্যান্য ক্যানসারের উপস্থিতি, পরিবারে ক্যানসারের ইতিহাস, নডিউলের বৈশিষ্ট্য, অন্যান্য গ্রন্থির আক্রান্ত হওয়ার ওপর চিকিৎসক যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারেন এটি ক্যানসার কিনা। এমন নডিউল দেখা দিলে ঘাবড়ে না গিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
লেখক : লে. কর্নেল ডা. নাসির উদ্দিন আহমদ