ডলার সঙ্কটে গত ছয় মাস ধরে স্টিল মিলের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। তিন মাস পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এখন চাহিদার ১০ থেকে ২০ শতাংশ আমদানি করা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের হাতে থাকা এ শিল্পের কাঁচামালের মজুদ শেষ হয়ে এসেছে। এখন শিল্পের ৪০ শতাংশ উৎপাদন নামিয়ে আনা হয়েছে। তাও আবার কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসাথে অনেকগুলো মিল বন্ধ হয়ে যাবে। আর এটা হলে এ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ। স্টিল মিলের মতো অনেক শিল্পেরই প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না।
এতে উৎপাদন অর্ধেকের নীচে নেমে গেছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে অর্থনৈতিক সঙ্কট বড় আকারে দেখা দেবে। গতকাল মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) আয়োজিত ‘সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় ও মুক্ত আলোচনায় এমসিসিআইয়ের সভাপতি মো: সাইফুল ইসলাম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে গত বছর থেকে দেশে তীব্র আকারে ডলার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে বাধ্য হয়ে রিজার্ভ থেকে খরচ করেছে সরকার। ব্যাংক জরুরি মুহূর্তে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছে না অভিযোগ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই কিন্তু আমরা আগের মতো সহজে এলসি খুলতে পারছি না। কারণ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ডলার সাপোর্ট দিতে পারছে না। তাই এখনো কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে অনেক সময় লাগছে।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মো: সিরাজুল ইসলাম মোল্লাহ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ডলার সঙ্কটের কারণে সিরামিকস শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। তিনি জানান, চাহিদার খুবই সামান্য পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে। একে তো গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে, এরওপর কাঁচামাল সঙ্কটের কারণে উৎপাদন অনেক কমে গেছে। তিনি জানান, নানাবিধ সমস্যায় ভুগছেন তারা। এত সমস্যা যা বলে শেষ করা যাবে না।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীরা শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য আসছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় ডলার সংস্থান করতে না পারায় এলসি খুলতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা অন্য ব্যাংকে যাচ্ছেন। এভাবে তারা ভালো ভালো গ্রাহক হারাচ্ছেন। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও এ বিষয়ে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু সরকারি কেনাকাটায় বিশেষ প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি হয়েছিল ৭৬২ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরের সাড়ে সাত মাসেই বিক্রি করেছে ৯৬৭ কোটি ডলার। এতো অল্প সময়ে এতো বিপুল পরিমাণ ডলার রিজার্ভ থেকে আগে কখনো বিক্রি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে, এর বেশির ভাগই বিক্রি করা হয়েছে সরকারি কেনাকাটায় সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে যৎসামান্যই বিক্রি করা হয়েছিল। অন্য ব্যাংকের চাহিদার কিছু অংশ মেটাতে গেলে আরো কয়েক বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হতো। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি নির্ধারিত পরিমাণে ধরে রাখতে সব ব্যাংকের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ স্টীল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টীল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ এ বিষয় গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, এমনিতেই গ্যাসের দাম প্রায় ২০০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর ওপর এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। তিনি জানান, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর পুরোপুরি এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা বন্ধ ছিল। এখন চাহিদার ১০ থেকে ২০ শতাংশ আমদানির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের হাতে থাকা মজুদও শেষ হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে কিছু চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। কিন্তু তাও আবার দাম অনেক বেশি। তিনি বলেন, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ রয়েছে। এ কারণে এ রডের স্বল্পতা অনুভব করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে এ শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ শতাংশও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। যেভাবে উৎপাদন কমে যাচ্ছে হঠাৎ একদিন এক সাথে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, এ শিল্পের সাথে নির্মাণ শ্রমিক, সিমেন্ট শিল্প, ইট, পাথরসহ হাজারো শিল্প ও শ্রমিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে।
স্টীল মিলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে। তিনি মনে করেন, স্বল্প পরিমাণ হলেও সব ধরনের পণ্য আমদানির অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। বিলাসী পণ্যসহ অন্যান্য তৈরি পণ্য আমদানি করতে না দিলে মানুষ তাদের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে আমদানি করবে নানা উপায়ে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অপর দিকে অনৈতিক উপায়ে ডলার পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।