বরিশালে ফসলি জমি দখল করে গড়ে উঠছে একের পর এক ইটভাঁটা। এর মধ্যে কোনোটা বৈধ আবার কোনোটা অবৈধ। বৈধের চেয়ে অবৈধ ভাঁটার সংখ্যাই বেশি। তবে বৈধ-অবৈধ যাই হোক না কেন, সব ইটভাঁটাতেই অবাধে পুড়ছে কাঠ।
পরিবেশ অধিদফতরের দৃশ্যমান কোনো অভিযান না থাকায় এই দণ্ডনীয় অপরাধ নির্বিঘ্নে করে যাচ্ছেন ভাঁটা মালিকরা।
৭ শতাধিক ভাঁটার কালো ধোঁয়ায় ক্রমেই দূষণের মেঘে ঢেকে যাচ্ছে প্রাচ্যের ভেনিসের আকাশ। জানা গেছে, বরিশালে ফসলি জমির দাম কম হওয়ায় একটি চক্র এসব জমি স্বল্পমূল্যে ক্রয় করে গড়ে তুলছে ইটভাঁটা।
এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট সংকটে অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না বরিশাল পরিবেশ অধিদফতর। বিভাগের ৬ জেলায় ৪৯১টি বৈধ ইটভাঁটা ও অনিবন্ধিত ২২৪টি ইটভাঁটায় নিয়ম না মেনে কয়লার পরিবর্তে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এতে যেমন ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের, তেমনি ধ্বংসের মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। আর এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন পরিবেশবাদীরা। তাদের মতে, সংশ্লিষ্ট দফতরের নখদন্তহীনতার সুযোগেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভাঁটা মালিকরা।
অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ছাড়পত্র ছাড়াই বরিশালে গড়ে উঠেছে একের পর এক ইটভাঁটা।
সেসব ভাঁটায় কয়লার পরিবর্তে দিন-রাত কাঠ দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে ইট। ৭ শতাধিক ভাঁটার ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল।
জানা গেছে, প্রভাবশালীদের সরাসরি হস্তক্ষেপ বা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই শত শত ইটভাঁটা পরিবেশ ধ্বংস করে চলেছে।
এদের বিরুদ্ধে রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা গ্রহণ করে না পরিবেশ অধিদফতর। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর উপজেলায় ইটভাঁটার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নে এক বছর আগেও ছিল ১১টি ইটভাঁটা। অথচ এখন এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪টিতে।
বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি ইউনিয়নে আগে ২১টি ইটভাঁটা থাকলেও বর্তমানে হয়েছে ৩২টি। সেখানে প্রকাশ্যেই পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
বাকেরগঞ্জের একটি ইটভাঁটার মালিক সেকান্দার আলী বলেন, কয়লায় ইট পোড়ালে ইটের দাম বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে কাঠ পোড়াতে হচ্ছে।
ইটভাঁটায় পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু এক বছরেও পাইনি। এতে নানা জটিলতা রয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের সঙ্গে চুক্তি না করলে ছাড়পত্র পাওয়া যায় না।
তবে পরিবেশ অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. আবদুল হালিম জানিয়েছেন, অভিযান পরিচালনার জন্য তাদের ম্যাজিস্ট্রেট সংকট রয়েছে। তিনি বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট সংকটে প্রয়োজন অনুযায়ী অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
জেলা প্রশাসনের কাছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে পাওয়া যায় না। তাই আমরা বিভিন্ন সময় হেড অফিস থেকে ম্যাজিস্ট্রেট এনে অভিযান পরিচালনা করছি। তারপরও চেষ্টা করছি অবৈধ ইটভাঁটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার।
পরিবেশ অধিদফতর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, বিভাগে বৈধ ইটভাঁটার সংখ্যা ৪৯১টি। আর অনিবন্ধিত ইটভাঁটা ২২৪টি। এই তথ্য নিবন্ধনের আবেদনের ওপর তৈরি করে প্রস্তুত। অথচ পুরো বিভাগের ৬ জেলার ৪২টি উপজেলায় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার তথ্যে রয়েছে বিশাল ফারাক।
সরকারি হিসাবে বরিশালের হিজলা উপজেলায় মোট ১৯টি ইটভাঁটা রয়েছে। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিয়েছে ১৩টি। কিন্তু বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ বলছে, হিজলা উপজেলায় মোট ৫৬টি ইটভাঁটা রয়েছে এবং নিয়মিত ইট পুড়ছে।
এ অবস্থা শুধু হিজলা উপজেলার নয়, পুরো বিভাগের ৬ জেলার ৪২টি উপজেলার। প্রতিটি ভাঁটার সামনে নামমাত্র কয়লা রেখে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। তা ছাড়া যারা আবেদন করেনি তারা অবৈধভাবে ইটভাঁটা চালালেও অবৈধ তালিকায় নেই তাদের নাম।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, জলবায়ু সংকটের এই সময়ে এভাবে কাঠ ব্যবহার করে ভাঁটার চুল্লি চালু রাখলে বায়ুমণ্ডলের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল। সরকারি দফতরকে নখদন্তহীনভাবে দায়িত্ব পালন না করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান তারা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বরিশাল জেলার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট লিংকন বাইন বলেন, ইটভাঁটা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অথচ প্রতি বছরই এগুলোর সংখ্যা বাড়ছে।
তার মধ্যে জিগজ্যাগ দেখিয়ে ইটভাঁটার অনুমোদন নিয়ে ড্রাম-চিমনিতে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। তিনি আরও বলেন, ছাড়পত্র দেওয়ার পর তদারকির যে দায়িত্ব রয়েছে, সেটা সঠিকভাবে পালন করছে না পরিবেশ দফতর। এটা তাদের ব্যর্থতা। তাদের নীরবতার পেছনে কোনো স্বার্থ কাজ করছে কি না খতিয়ে দেখা দরকার।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. আবদুল হালিম বলেন, আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট সংকট।
তার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করছি অবৈধ ইটভাঁটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার। তা ছাড়া অবৈধ ইটভাঁটার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন ছাড়পত্র ছাড়া কোনোভাবেই চালানোর সুযোগ নেই। সে যেই হোক আমরা ব্যবস্থা নেব।