কয়েকদিন ধরে ঘন কুয়াশার কারণে অবতরণে সমস্যা হওয়ায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আকাশে চক্কর দিয়ে অবতরণে ব্যর্থ হলে দেশের বা পাশ্ববর্তা দেশের অন্য বিমানবন্দরে অবতরণ করতে বাধ্য হচ্ছে ফ্লাইটগুলো। এতে অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ এবং অবতরণ ও পার্কিংসহ অন্যান্য চার্জ মিলিয়ে একেকটি ফ্লাইটের ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। বিষয়টি প্রাকৃতিক মনে হলেও কুয়াশা ভেদ করে বিমান অবতরণের যে পদ্ধতি, মূলত শাহজালাল বিমানবন্দরে সেটির আধুনিকায়নের অভাবেই এ সমস্যা হচ্ছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিমানবন্দরে উন্নত ইনস্ট্রুুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) থাকলে কম ভিজিভিলিটিতেও (দৃশ্যমানতা) বিমান অবতরণ করাতে সক্ষম হতেন পাইলটরা।
ঝড় ও কুয়াশাসহ আবহাওয়াজনিত কারণে বিমান চলাচল ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমানবন্দরের দৃশ্যমানতা কমে আসায় বিমানের অবতরণ সম্ভব হয় না। রানওয়েতে সাধারণত দৃশ্যমানতা ৬০০ থেকে ৮০০ মিটার থাকলে উড়োজাহাজ ওঠানামা করে। এটি তিন হাজার মিটার বা তার নিচে নামলেই আবহাওয়া অধিদপ্তর এভিয়েশন ওয়ার্নিং দেয়, সেটি দুই হাজার বা তার নিচে এলে তখন বিমান নামতেও পারে না। তবে সে সময়ে ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) ব্যবহার করে কম ভিজিবিলিটিতেও বিমানকে অবতরণ করাতে সক্ষম হন পাইলটরা। এ জন্য আইএলএস ক্যাটাগরি-২ থাকা জরুরি। শাহজালাল বিমানবন্দরে রয়েছে আইএলএস ক্যটাগরি-১। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দরকার যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন। এটাকে বলে এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (এটিএম)। এটিএম ব্যবস্থা আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি আজও।
অনেক দেশের বিমানবন্দরে ক্যাটাগরি-৩ রয়েছে। সেই তুলনায় শাহজালালে এখনো আইএলএস ক্যটাগরি-১ থাকা দুর্বল ব্যবস্থাপনার লক্ষণ বলে মনে করেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) তাগিদ দিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে আইএলএসের ক্যটাগরি ১ থেকে ২-এ উন্নীত করতে হবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও উইং কমান্ডার (অব) এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, কুয়াশার কারণে বিমান অবতরণে ব্যাঘাত ঘটছে। শীত এলে এ সমস্যা হতেই পারে। এ জন্য গোটা এটিএম সিস্টেম আধুনিকায়ন করতে হবে। আপাতত ভোগান্তি এড়াতে ফ্লাইট শিডিউল পুনর্বণ্টন করা দরকার। এতে করে অবশ্য যাত্রী ভোগান্তি কমবে না। এর সমাধানে কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে।
জানা গেছে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল বিঘœ ঘটে। তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এ দুই মাসে কুয়াশা বাড়ার কারণে দুর্যোগও বাড়ে। রাতে সমস্যা কম হয়, সকালের দিকে কুয়াশা বেশি থাকায় ভিজিভিলিটি কমে আসে। তখন ফ্লাইট নামতে পারে না। কোনো কারণে বিদ্যুৎ চলে গেলে বা বিদ্যুতের পরিবর্তে জেনারেটর চালু করলেও ক্যাটাগরি ১-এ থাকা আইএলএস পুনরায় চালু হতে ৮ সেকেন্ড লাগে। দ্রুতগতিতে আসা বিমান ৮ সেকেন্ড সময়ে আইএলএস ছাড়া কম ভিজিবিলিটিতে অবতরণ করলে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এ জন্য বলা হয়, আইএলএস ক্যাটাগরি-২ থাকলে এ ধরনের কোনো সংকট থাকে না। ক্যাটাগরি ২-এ উন্নীত হলে ২০০ মিটার ভিজিবিলিটিতেও উড়োজাহাজ অবতরণ করতে পারবে। তবে জিরো ভিজিবিলিটিতে উড়োজাহাজ নামতে পারবে না। এ জন্য ক্যাটাগরি ৩-এ উন্নীত করার প্রয়োজন হবে।
এয়ারলাইনসসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যেক বিমানবন্দরে অবতরণে জন্য চার্জ দিতে হয়। একই সঙ্গে পার্কিং চার্জও দিতে হয়। কোনো কারণে নির্ধারিত বিমানবন্দরে নামতে না পারলে বিমানটি অন্য বিমানবন্দরে অবতরণ করলে সে বিমানবন্দরে বাড়তি ল্যান্ডিং ও পার্কিং চার্জ দিতে হয়। একই সঙ্গে নির্ধারিত রুট পরিবর্তন করার ফলে জ্বালানি খরচও বাড়ে। অন্যদিকে একটি ফ্লাইট শিডিউল বিপর্যয় ঘটলে ধারাবাহিকভাবে অন্য ফ্লাইটগুলোতেও এর প্রভাব পড়ে।
শাহজালাল বিমানবন্দর সূত্র জানায়, দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেশি ফ্লাইট পরিচালিত হয়। এ বিমানবন্দরে ২৪ ঘণ্টা দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর প্রায় ১৫০টি ফ্লাইট ওঠানামা করে। এ অবস্থায় আইএলএস ক্যাটাগরি ২-এ আপগ্রেডেশনের উদ্যোগ নিয়েছে বেবিচক। এ জন্য নেওয়া প্রকল্পের জন্য লাইট, ম্যাটসহ আনুষঙ্গিক অনেকগুলো উপাদান দরকার। কিন্তু উদ্যোগটি বাস্তবায়ন হয়নি আজও।
এ বিষয়ে এয়ারলাইনস ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেবিচকের উচিত দ্রুত আইএলএস ক্যাটাগরির উন্নয়নে ব্যবস্থা নেওয়া। কেবল শাহজালাল বিমানবন্দর নয়, ঢাকার বাইরে সৈয়দপুর ও যশোরের অবস্থা আরও খারাপ। সেখান বিকাল বেলা থেকেই বিমান অবতরণ কঠিন হয়ে যায়। কুয়াশা হলেই আকাশে দেড়-দুই ঘণ্টা চক্কর দিতে তেল পোড়ে, যাত্রীরা বিরক্ত হন। কুয়াশার কারণে একটি ফ্লাইটের যখন দেরি হয়ে যায়, তখন শুধু ওই ফ্লাইটের যাত্রী নন, ফিরতি ফ্লাইটের যাত্রীরাও ভোগান্তিতে পড়েন। টাওয়ার অনুমতি না দিলে ফ্লাইট নামতে পারে না।
তারা আরও বলেন, প্রতিদিন সকালে সাত থেকে আটটি ফ্লাইট ডাইভার্ট (ভিন্ন গন্তব্যে পাঠানো) হচ্ছে। এতে তেল খরচ, ল্যান্ডিং চার্জসহ অপারেশন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আবার আমরা শিডিউল যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারছি না। কানেকটিং ফ্লাইটের যাত্রীদের অবস্থা আরও করুণ। তাদের আর্থিক ক্ষতি ও ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে দ্রুত যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন দরকার।