২০২৩ সালের ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক ইতোমধ্যে মাদরাসাগুলোতে পৌঁছেছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর মোট বইয়ের সংখ্যা ১৫টি, তার মধ্যে মাত্র চারটি বই ইসলামী ও আরবি বিষয়ের, বাকি ১১টি বই সাধারণ শিক্ষার। সাধারণ শিক্ষার বইগুলো হলো- ১. জীবন-জীবিকা; ২. স্বাস্থ্য সুরক্ষা; ৩. বিজ্ঞান অনুশীলন; ৪. বিজ্ঞান অনুসন্ধান; ৫. ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন; ৬. ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধান; ৭. গণিত; ৮. ইংরেজি; ৯. ডিজিটাল প্রযুক্তি; ১০. চারুপাঠ; ১১. শিল্প সংস্কৃতি। আরবি চারটি বিষয় হলো- ১. আকাঈদ ফিকহ; ২. কুরআন মজিদ; ৩. কাওয়াঈদুল লোগাতুল আরাবিয়া; ৪. লুগাতুল আরাবিয়া এত্তেছালিয়া।
শোনা যাচ্ছে- মাদরাসার কেন্দ্রীয় (পাবলিক) পরীক্ষা মাত্র আরবি ১০০ নম্বরের একটি বিষয়ের পরীক্ষা হবে। তা ছাড়া আরবি অন্য বিষয়গুলোর পরীক্ষা হবে না, শিক্ষকরা মূল্যায়ন নম্বর দেবেন, বাকি সাধারণ বিষয়গুলোর পরীক্ষা হবে।
পাঠ্য বইগুলোর বিভিন্ন গল্প, কবিতা, মূর্তিও ছবি নিয়ে ওলামা-মাশায়েখ ও পীর সাহেবরা প্রতিবাদ করছেন, তারা প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। আমি তাই সে বিষয়ে কিছু লিখব না। মাদরাসা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও অতীতে এ শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে কিছু লিখব। আমি আমার গ্রামের পাশের মন্তলী রহমানিয়া ফাজিল মাদরাসায় পড়ালেখা করেছি, একই মাঠের এক পাশে মাদরাসাটি এবং অপর পাশে ছিল মন্তলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ। বর্তমানে স্কুলটি সামান্য সরিয়ে দু’টি প্রতিষ্ঠানের মাঠ আলাদা করা হয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতে ছাত্রসংখ্যা কম নেই। যদি প্রশ্ন করা হয়- পাশাপাশি স্কুল ও মাদরাসা হওয়ার পরও মানুষ তার সন্তানকে মাদরাসায় কেন ভর্তি করাচ্ছে? উত্তর আসবে- ভালো আলেম হওয়ার জন্য। আলেম বানানোর ইচ্ছা না থাকলে অবশ্যই স্কুলে ভর্তি করাত।
দুনিয়াবি চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক শিক্ষার সাথে পরিচিত হতে যতটুকু না হলে নয় এর বেশি সাধারণ শিক্ষার বোঝা মাদরাসায় না চাপিয়ে ভালো আলেম হওয়ার উপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন আবশ্যক। সাত অন্ধ হাতি দেখতে গিয়ে যে অঙ্গ যিনি ধরেছেন তিনি হাতিকে সেরূপই মনে করেছেন এবং হাতির আকৃতি নিয়ে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছেন। কারণ তিনি নিজে ধরে অনুভব করেছেন, তাই অন্য জনের কথা মানতে তিনি রাজি নন। যদি তাদের চোখ থাকত- সম্পূর্ণ হাতি দেখত তবে ঝগড়া হতো না, ঠিক তেমনি ভালো আলেম না হলে ইসলামের আংশিক জ্ঞান লাভ করে যিনি যতটুকু বুঝবেন ততটুকুকে চূড়ান্ত মনে করে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হবেন, যা ইসলাম ও মুসলিম জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। একজন চিকিৎসকের চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী হতে হয়, একই সাথে চিকিৎসকের ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাশিক্ষা লাভের প্রয়োজন নেই। তাকে কেউ প্রশ্ন করে না তুমি চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা জানো না কেন? সেভাবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভালো আলেম হওয়ার শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন, তাকে সাধারণ শিক্ষায় পারদর্শী করতে সিলেবাসের বোঝা চাপিয়ে দিতে হবে কেন? মোগল আমলে বা তারও আগে আলেমদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো, আলেমরা শিক্ষাবিস্তারে কাজ করতেন, তাদের বেতন মন্ত্রীর সমান ছিল।
ইংরেজ আসার আগে এলাকার ভূমি ওয়াক্ফ হিসেবে সরকার মাদরাসার হাতে দিয়েছিল, যা থেকে মাদরাসার ব্যয় যেমন নির্বাহ হতো জনগণের চাহিদার আলোকে এলাকার উন্নয়নকাজে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ অর্থ বরাদ্দ দিত। তখন শুধু বাংলায় ৮০ হাজার মাদরাসা ছিল। ইংরেজরা আলেম ও মুসলমানদের এ মর্যাদা দেখে এবং সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসে এসব সম্পত্তি মাদরাসার নিয়ন্ত্রণ থেকে নিয়ে যায়, ফলে অর্থাভাবে মাদরাসাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অনেক বছর পর মুসলিম নেতারা চিন্তা করলেন মাদরাসা ও আলেম না থাকলে এক সময় ইসলাম ও মুসলিম বলতে কিছু থাকবে না। তাই তারা ইংরেজ সরকারের কাছে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে আলোচনা করেন। ইংরেজ সরকার সেখানে ইংরেজবিরোধী কিছু হয় কি না এ আশঙ্কায় অধ্যক্ষ হবে ইংরেজ- এ শর্তে দাবি মেনে নেয়। সরকারি রোষানলে পড়ে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ক্ষতিগ্রস্ত হবে চিন্তা করে মুসলিম নেতারা ইংরেজ সরকারের শর্ত মেনে নেয়। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয়নি, নেতারা নিজেদের অর্থে ১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সিলেবাস ও পাঠ্যসংক্রান্ত বিষয়ে অধ্যক্ষের হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল না, এ দায়িত্ব যিনি পালন করতেন তার পদবি ছিল হেড মাওলানা। কলকাতা আলিয়ার প্রথম হেড মাওলানা ছিলেন মোল্লা মজদুদ্দীন। আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর সেখান থেকে অসংখ্য যোগ্য আলেম তৈরি হয় যাতে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়। এর প্রায় ১০০ বছর পর ১৮৬৬ সালে ইংরেজ আমলে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে পরিচালনার জন্য স্থাপিত হয় কওমি মাদরাসার মূল ভিত্তি দেওবন্দ মাদরাসা।
তখন আলিয়া ও কওমি মাদরাসার সিলেবাস একই রকম ছিল। কুরআন-হাদিস, ফিকহ ইত্যাদি ভালো আলেম হওয়ার মতো সিলেবাস ছিল, সাধারণ বিষয় ছিল না। আলিয়া থেকে পাস করে কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন, কওমি মাদরাসা থেকে পাস করে আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করে বেতনভাতা নিতেন। ১৯৮০ সালে সরকার জনবল কাঠামো ও শিক্ষাগত সনদ নির্ধারণ করে দিলে কওমি সনদ দিয়ে আলিয়ায় চাকরির সুযোগ শেষ হয়। মূলত তখন থেকে কওমি শিক্ষিতরা আলিয়ার সমালোচনা শুরু করে।
এবার আবার পেছনের আরেকটি দিক তুলে ধরি। ১৯১৫ সালে আলিয়াতে সাধারণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে নিউ স্কিম এবং সাধারণ বিষয় ছাড়া ওল্ড স্কিম- এ দু’ধারায় বিভক্ত করা হয়। শর্ষিনা আলিয়া, সিলেট আলিয়া, ঢাকা আলিয়ার একাংশ নিউ স্কিম সিলেবাস গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, তারা ওল্ড স্কিমে থেকে যায়। একপর্যায়ে ১৯৫৭ সালে সরকারি এক ঘোষণায় সব নিউ স্কিম মাদরাসা স্কুল-কলেজে পরিণত হয়। লাকসাম নবাব ফয়জুন্নেসা তার বিশাল সম্পত্তি মাদরাসার নামেই ওয়াক্ফ করে, কিন্তু তা এখন নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামে মোহসিনিয়া মাদরাসা এখন মোহসিন কলেজে পরিণত হয়েছে। এভাবে তিনটি ছাড়া সব মাদরাসা কলেজে পরিণত হয়েছে। এভাবে মিসরে ও নানা যুক্তি এবং প্রলোভনে মাদরাসায় সাধারণ বিষয় পাঠ্যভুক্ত করতে করতে ইসলামী শিক্ষা বিলুপ্ত করা হয়েছে। আজকের আলিয়া মাদরাসার সিলেবাস দেখে মনে হচ্ছে- এগুলোও সেই পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ আগে স্কুলে ১০০ নম্বরের আরবি ১০০ নম্বরের ইসলাম শিক্ষা পরীক্ষা দিতে হতো। আরব অনেক দেশে একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া ছাত্রকে ও তার বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষার সাথে সাথে কুরআন-হাদিসের একটি নির্দিষ্ট সিলেবাসের পরীক্ষা দিতে হয়। বর্তমানে মাদরাসায় যে সিলেবাস ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে এ সিলেবাস স্কুল-কলেজের জন্য প্রয়োজন।
মাদরাসায় গত কিছু দিন আগেও বাংলা ও ইংরেজি ১০০ নম্বর করেছিল। ১০০ নম্বর পড়েই তারা ২০০ নম্বর পড়ুয়া স্কুল-কলেজ ছাত্রদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারত। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় শর্তারোপ করে ২০০ নম্বর করে বাংলা ইংরেজি না থাকলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে না। ফলে ২০০ নম্বর করে ৪০০ নম্বরের বাংলা ও ইংরেজি দিতে গিয়ে মাদরাসার মূল আরবি বিষয় সঙ্কুচিত করা হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর। তার কাছে আবেদন মাদরাসা ছাত্রদের আগের মতো ১০০ নম্বর করে বাংলা ইংরেজি রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও সুযোগ রাখা হোক। মাদরাসার সিলেবাসে সাধারণ বিষয়ের বোঝা কমিয়ে যোগ্য আলেম তৈরির পথ সুগম করা হোক। মাদরাসার সিলেবাস প্রণয়নের দায়িত্ব শুধু মাদরাসা শিক্ষিতদের হাতে দেয়া হোক। সে সাথে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মাদরাসা সিলেবাস থেকে ও প্রশ্ন রাখার ব্যবস্থা রাখা হোক।
লেখক : অধ্যক্ষ, ফুলগাঁও ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা