সম্প্রতি বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জনগণকে পলিশ করা চাল না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেন, যদি আমরা সঠিকভাবে আবাদ করি, আর যদি পলিশ করা চাল খাওয়া কমাতে পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের খাদ্য বাহির থেকে আনার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই।
এক সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, পলিশ করার জন্য বা চাল সিল্কি করার জন্য চালের বাইরের কিছু অংশ নষ্ট হয়। প্রতি ১০০ টন চালে পাঁচ টন চাল কমে যায়।
তিনি বলেন, এই হিসেবে এক কোটি টন চালে ২০-২২ টন চাল হাওয়া হয়ে যায়।
চালের পলিশ করা এই অংশ ভাত, সুজি কিংবা আটা কোনোভাবেই ব্যবহার করা যায় না বলেও উল্লেখ করেন খাদ্যমন্ত্রী।
চাল পলিশ করাটা কী?
রাজধানীর বাবুবাজার এলাকায় চালের পাইকারি আড়ত রয়েছে হাজী আলমগীর হোসেনের। একইসাথে তার একটি অটো রাইসমিলও রয়েছে যেখানে চাল প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, বাজারে প্রচলিত যে ধারণা রয়েছে যে, মোটা চালকে কেটে সরু করা হয় সেটি আসলে ঠিক নয়। চাল কেটে সরু বা লম্বা করা যায় না। তবে চালকে পরিষ্কার ও ঝকঝকে করার পদ্ধতি রয়েছে যাকে পলিশ বলা হয়।
এই পদ্ধতিতে চালের উপরের যে আবরণটা তুলে ফেলা হয় যার কারণে চালটা চকচকে ঝকঝকে করা হয়।
আলমগীর হোসেন বলেন, বাজারে চকচকে চালের চাহিদা থাকার কারণে রাইসমিলগুলো এটি করে থাকে। গৃহিনীদের কাছে পাথরবিহীন, এই চকচকে চাল বেশ জনপ্রিয় বলে জানান তিনি।
এসব চালের মধ্যে রয়েছে মিনিকেট, নাজিরশাইল, বাসমতি ইত্যাদি। এসব চাল মূলত ইরি-২৮,ইরি-২৯, রঞ্জিত, শম্পাকাটারি, পঞ্চাশ ও অন্যান্য জাতের ধান পলিশ করে বানানো হয়।
কিভাবে চাল পলিশ করা হয়?
রাইসমিল মালিক হাজী আলমগীর হোসেন বলেন, দুই উপায়ে চালকে পলিশ করা হয়। একটি হচ্ছে প্রচলিত পদ্ধতি অর্থাৎ ধান পাকার পর সেটিকে মাড়াই, সিদ্ধ ও রোদে শুকানোর পর হাস্কিং মেশিনে ভাঙ্গানো হয়।
এতে ধানের খোলস আলাদা হয়ে চালটা বেরিয়ে আসে। এই চালের উপরে লাল আবরণ থাকে। সাথে বিভিন্ন ধরণের কাঁকড়-পাথর ও মরা চাল থাকে। এই চাল দেখতেও ঘোলাটে হয়। এই ঘোলাটে বা লালচে চাল বাজার থেকে কিনে সেটিকে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে বাছাই ও পলিশ করা হয়।
তিনি আরো বলেন, এই চালটা কিনে এনে আমরা মেশিনে দিলে কালো (চাল), লাল আমরিট (চাল) ও ভাঙ্গা (চাল) আলাদা হয়ে যায়। আমরা এর সাথে একটা পলিশার বসাই। এইটা উপরের আবরণ ছাইটা দেয়ার জন্য আমরা এইটা ফ্রেশ কইরা নিয়া আসি।
এছাড়া অটোমেশিনে আরো সহজেই চাল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এতে কাঁচা ধান মেশিনে দিলে সেটি প্রক্রিয়াজাত হয়ে সরু চাল হিসেবে বের হয়ে আসে।
এই অটোমেটিক মেশিনের সাথে পাথর আলাদা করার মেশিন এবং চাল পলিশের মেশিন যুক্ত করা থাকে।
তবে অনেক সময় মিল মালিকরা চাল চকচকে করার জন্য নানা রকমের রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকেন বলেও জানা যাচ্ছে। এর মধ্যে চালকে সাদা করার জন্য ফিটকিরি ব্যবহার করা হয়।
আলমগীর হোসেন রাসায়নিক ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেন, পাঁচ কেজি পানির সাথে ফিটকিরি মিশাইয়া হালকা স্যালাইন দিয়ে দিলে চালটা পরিষ্কার আরো বেশি হয়।
আবার অনেক রাইস মিল মালিকরা ইউরিয়া সারের পানি মিশিয়েও চাল সাদা করেন।
তিনি বলেন, যে চাল বেশিবার ঘষা হয় সেটি বেশি মসৃন হয়ে পিচ্ছিল ভাব আসে। তবে এতে কোনো মোম ব্যবহার করা হয় না। প্রেসার যত বেশি দিবে, তত চকচক-ঝকঝকা, পিছলা বেশি হবে। আয়নার মতো পরিষ্কার হবে, কেউ চারটা চাপ দিয়ে করে, কেউ দুইটা করে।
চাল পলিশ করার সময় কিছুটা ঘাটতি হয় বলেও জানান তিনি। তার তথ্য অনুযায়ী, ৫০ কেজি চাল পলিশ করলে আধা কেজি ওজন কম হয়।
উপজাত কী হয়?
চাল পলিশ করানোর পর এর যে উপজাত পণ্য বের হয় সেটিও আলাদা করে বিক্রি করা যায়। এই উপজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে তুষ, চালের গুঁড়া ইত্যাদি। এই উপজাত পণ্যগুলো আবার আলাদা করে বিক্রি করেন মিল মালিকরা।
আলমগীর হোসেন জানান, এক বস্তা তুষ বিক্রি হয় ১৮ শ থেকে ১৯ শ টাকায়। যারা এসব উপজাত পণ্য কেনেন তারা আগে থেকেই মিল মালিকদের কাছে বায়না দিয়ে রাখেন।
এই উপজাত পণ্যগুলো থেকে আবার বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপন্ন হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভোজ্যতেল।
বাজারে রাইস ব্রান অয়েল হিসেবে যে ভোজ্যতেল পাওয়া যায় সেটি উৎপাদিত হয় চালের এই উপজাত পণ্য থেকেই।
এছাড়া গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগীর খাবার হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এসব পণ্য।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে কি?
সরু করা চাল খাওয়া এবং এর পুষ্টিগুণ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।
পুষ্টিবিদরা বলেন, চালের উপরের আবরণ ফেলে দিয়ে সেটি সরু করা হলে চালটি অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ে না। তবে এর কিছু পুষ্টিগুণ কমে যায়।
বাংলাদেশ ডায়েট কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার বলেন, চাল থেকে আমরা যে ভিটামিন বি পাই সেটি আসলে চালের আবরণ বা বাইরের অংশেই বেশি থাকে।
তাই আবরণটি ফেলে দেয়া হলে চালে ভিটামিন বি এর পরিমাণ কমে যায়। চালের ভেতরের অংশে ভিটামিন বি বা থায়ামিনের পরিমাণ থাকলেও সেটি বেশ কম।
শুধু ভিটামিন বি নয়, চাল সরু করা হলে চালে যে ফাইবার থাকে সেটির পরিমাণও কমে যায়।
চাল সরু করার সময় চালে যদি রাসায়নিক হিসেবে ফিটকিরি বা ইউরিয়া ব্যবহার করা হয় তাহলে সেটির প্রভাব স্বাস্থ্যের উপর পড়ে কিনা সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার বলেন, ফিটকিরির কোনো প্রভাব স্বাস্থ্যের উপর পড়ে না। কারণ পানি বিশুদ্ধ করতেও আমরা অনেক সময় ফিটকিরি ব্যবহার করে থাকি। এটার আসলে দেহের উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব নেই।
তবে চাল সরু করার প্রক্রিয়ায় ইউরিয়া ব্যবহার করা হলে সেটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করেন এই পুষ্টিবিদ।
তিনি বলেন, ইউরিয়া হচ্ছে দেহের বর্জ্য পদার্থ। এটা যদি খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে সেটা অবশ্যই ক্ষতির কারণ হবে।
মিল মালিকরা বলছেন, ইদানিং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। পলিশ করা চালের তুলনায় দেখতে কিছুটা ঘোলাটে হলেও আবরণযুক্ত চালের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
এসব চালের স্বাস্থ্যগুণ সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ার কারণে তারা মোটা এবং ঘোলাটে আবরণযুক্ত চালের দিকেই ঝুঁকছে বলে মনে করেন তারা।
সূত্র : বিবিসি