রবিবার, ০৬:১২ অপরাহ্ন, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ

ড. এম এ সবুর
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০২২
  • ৯৪ বার পঠিত

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আবহমানকাল থেকেই এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। এ দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন সৌন্দর্যময় তেমনি এর অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাসও বৈচিত্রময়। আমাদের দেশের জনগণ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী। এ দেশের অধিবাসীরা বাঙালি, মণিপুরি, চাকমা, মারমা প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীতে বিভক্ত হলেও একক পরিচয়ে বাংলাদেশী।

বাংলাদেশের প্রধান সংস্কৃতি বাঙালি হলেও এ দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ ও প্রীতিময় করেছে সাঁওতাল-চাকমা, হাজং-ত্রিপুরাসহ অন্যান্য সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক এ সম্প্রীতির কারণে এদেশে খ্রিষ্টানদের বড় দিন, বৌদ্ধদের পূর্ণিমা উদযাপন, হিন্দুদের পূজা পালন এবং মুসলমানদের ঈদ উদযাপনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্য এসব ধর্মীয় দিনগুলোতে সরকারি ছুটি থাকে। এ দেশে রোজা-পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান এক সাথে উদযাপনের অনেক উদাহরণ আছে। হিন্দুদের পূজার অনুষ্ঠানে খ্রিষ্টান, মুসলমান ও বৌদ্ধদের এবং মুসলমানদের ঈদ-জলসাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও দাওয়াত দেয়ার রীতি আছে। এমনকি হিন্দু-বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-মুসলমানের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পারস্পরিক সহযোগিতারও প্রচলন আছে। বিয়ে, মেলা, নবান্নসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সকল ধর্মাবলম্বীর পারস্পরিক অংশগ্রহণ বহুল প্রচলিত। এমনিভাবে বাংলাদেশের সামাজিকতার বিভিন্ন পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান প্রভৃতি ধর্মের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত।

ধর্ম ও বিশ্বাসের ভিন্নতা সত্তে¡ও বাঙালি হিন্দু-মুসলিমের সংস্কৃতি অনেকাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ। আমাদের সামাজিক বন্ধনও হৃদ্যতাপূর্ণ। হিন্দু-মুসলিমের মিলিত সংস্কৃতিই বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে যেমন আজানের ধ্বনিতে মানুষের ঘুম ভাঙে তেমনি সূর্যাস্তের সময় সঙ্খধ্বনিও বেজে ওঠে। এ দেশের বোরকা পরিহিত মুসলিম আর সিঁদুর পরা হিন্দু নারীদের একসাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করার অভ্যাস আছে। আবার ধূতি-তিলক পরা হিন্দু পুরোহিতদের সাথে পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি-দাড়িওয়ালা মৌলবিদের দারুণ আড্ডা জমে। তাছাড়া আসর বসিয়ে হিন্দু-মুসলিম একসাথে বাউল-কীর্তন, মুশির্দী-মারফতি গান শোনে। তারা অযথা বিতর্ক-বিরোধে জড়িয়ে পড়েন না ধর্মীয় বিশ্বাসে ভিন্নতার কারণে। ধর্মীয় কিছু বিধি-নিষেধ ছাড়া মৌলিক কোন পার্থক্য নাই বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাসে। এমনিভাবে বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির দীর্ঘ ইতিহাস আছে। হিন্দু-মুসলিম বার ভূইয়াগণ সম্মিলিতভাবেই মোগল সৈন্যদের প্রতিরোধ করে বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখেছেন। মুসলিম শাসনামলে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়োগ দেয়ার অসংখ্য নজির আছে। বাংলা সাহিত্যও সমৃদ্ধ হয়েছে হিন্দু-মুসলিমের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সংস্কৃতিতে। মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশের হিন্দু সাহিত্যিকগণ দেব-দেবীর স্তুতিমূলক সাহিত্য রচনা করেছেন। মুসলিম শাসনামলে তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি হিন্দু ধর্মগ্রন্থাদি বাংলায় অনূদিত হয়েছে। এভাবে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব-সম্প্রীতি স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছেদ ঘটে।

ব্রিটিশ শাসকরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতিতে এ দেশের হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে। অনেক দিন পরে হলেও বৃটিশদের এ অপনীতি বুঝতে পেরে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছে। তবে ব্রিটিশরা বিভিন্ন সময়ে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে। তাদেরই কূট রাজনীতির কারণে ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে। যার পরিণতিতে বাংলা বিভাগের প্রবল দাবি ওঠে এবং ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হয়ে পড়ে।

তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুদৃঢ় হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি-গোষ্ঠী বা দল ভিন্ন ধর্মের বিশ্বাস ও লোকদের ওপর আক্রমণ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন সময় অতর্কিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর ও ধর্মীয় উপসানলয়ে আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। নিকট অতীতে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণ এবং পাবনার সাঁথিয়ায় ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘর-বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লার এক মন্দিরে আল কুরআন অবমাননার ঘটনায় এবং রংপুরের পীরগঞ্জে ফেসবুকে কাবা শরীফ অবমাননার পোস্ট দেয়ায় নোয়াখালী ও রংপুরসহ দেশের কয়েকটি জায়গায় পূজামন্দির ও বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে। কিছু দিন আগে ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নড়াইলে হিন্দুধর্মাবলাম্বীদের বাড়ি-ঘর ও দোকান-পাটে লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। কখনো রাজনৈতিক, কখনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে ঘটানো এসব ঘটনায় দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রশ্নবিদ্ধ এবং দেশের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

স্বার্থান্বেষী মহল দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। তারা ধর্মীয় উন্মাদনা ও সংখ্যালঘুদেরকে শিখণ্ডি হিসেবে ব্যবহার করে। এসব অনেক ঘটনায় রাজনৈতিক কারণে ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো’র চেষ্টাও চলে। যাতে প্রকৃত অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে এবং এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটে। এজন্য ধর্ম অবমাননাকারী, উসকানি দাতা ও হামলার সাথে জড়িত সবাইকে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষত ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিক তথ্য দিতে হবে। অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্তরা প্রভাবশালী অপরাধীদের ভয়ে সঠিক তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। সর্বোপরি প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করার এবং শাস্তি দেয়ার বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি, সমাজকর্মী, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com