অন্য ভাষায় :
রবিবার, ১০:৫৩ অপরাহ্ন, ০৫ মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

ইউরোপের স্বপ্নের হাতছানিতে মৃত্যুযাত্রা!

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৩
  • ৭০ বার পঠিত

স্বপ্নের হাতছানিতে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশের তরুণদের। মৃত্যুর এই যাত্রায় সবশেষ যুক্ত হয়েছে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার কলেজছাত্র তানিল আহমেদের নাম।

গত বছরের ঠিক এই সময়ে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে তীব্র তুষারপাতের কবলে পড়ে মারা যান বাংলাদেশী সাত তরুণ। এছাড়া ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রতিনিয়তই বাংলাদেশীদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কেন তরুণদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না এই অবৈধ যাত্রা থেকে আর কিভাবেই বা কমতে পারে এই মৃত্যুর মিছিল?

দুই বছর আগে বাবা গিয়াস উদ্দিন মারা গেছেন। সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় ২২ বছরের তরুণ তানিল আহমেদ। মাত্রই ডিগ্রি পাশ করেছেন। কিভাবে সংসার চালাবেন? ভাইবোনকে কিভাবে শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন, এ চিন্তা থেকেই বিদেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিল তিল করে জমানো চার লাখ ৯০ হাজার টাকা তুলে দেন গ্রামের শাহীন মিয়ার হাতে। তাকে তানিলরা চাচা বলেই সম্বধোন করতেন। একদিন মেলে বিদেশ যাওয়ার সুযোগও। উড়াল দেন তানিল। মাত্র সাড়ে তিন মাসের মাথায় এলো মৃত্যু সংবাদ।

তানিলরা চার ভাই আর তিন বোন। তানিলের চেয়ে দুই বছরের ছোট জামিল আহমেদ। কেবল এইচএসসি পাশ করেছেন। এখন ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ডয়চে ভেলের সাথে আলাপকালে জামিল বলেন, ‘ভাই ইরানে যাওয়ার পর কোম্পানি খুঁজে পায়নি। অনিশ্চিত একটা অবস্থার মধ্যে পড়েছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওরা কয়েকজন মিলে তুরস্ক হয়ে গ্রিসে যাবে। এর মধ্যেই ওর সাথে থাকা মাসুম আহমেদ আমাকে ফোন করে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর দিয়েছে। ছবিও পাঠিয়েছে। এরপর আর শাহীন চাচা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেননি। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ। ছোট ছোট দুই ভাই আর তিন বোনকে নিয়ে আমি কিভাবে চলবে’?

তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম ভাই টাকা পাঠালে ডিগ্রি ভর্তি হব। এখন তো আর সেটাও হবে না। পাড়ার কোনায় আমাদের একটা টং দোকান আছে। এখন আমাকে সেটাই দেখতে হবে। খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছি আমরা। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শোনার পর মা সেলিনা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ভাই-বোনগুলো শুধুই কাঁদছে।’

তানিলের চাচা নূর মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা যেটা জেনেছি, আগে ওকে মারধর করা হয়েছিল। পরে কয়েকজন দালালের মাধ্যমে হেঁটে ইরান থেকে তুরস্ক হয়ে গ্রিসে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিল তানিল। তখন তীব্র ঠান্ডা ছিল। তুরস্ক সীমান্তের কাছাকাছি একটি পাহাড়ে গিয়ে তানিল ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেখানেই সে মারা যায়। মৃত তানিলের ছবিও ওর সাথে থাকা লোকজন আমাদের পাঠিয়েছে। এখন তানিলের লাশটি আমরা কিভাবে দেশে ফিরিয়ে আনব সেই চিন্তাই করছি। গ্রামের দালাল শাহীন মিয়া ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। লোকের মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ হয়েছে। তার কাছে আমরা অনুরোধ করেছি, অন্তত লাশটি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে দিক। আমি স্থানীয় চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছি যাতে তানিলের লাশটি দেশে আনার ব্যবস্থা করে দেন। তিনি চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন।’

স্থানীয় পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান জায়গীরদার খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘তানিলের চাচা আমাকে বিষয়টি বলেছেন। আমি ইউএনও সাহেবকে অনুরোধ করেছি যাতে লাশটি ফেরত আনার ব্যবস্থা করে দেন।’

এভাবে তরুণরা যে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যে যাচ্ছে, আপনারা কি জানেন না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই আমাদের এই এলাকা থেকে ৮-১০ জন করে তরুণ বিদেশে যাচ্ছে। আমরা নানাভাবে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেও পারছি না। দালালদের বিরুদ্ধে কেউ মামলাও করে না। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। এর বাইরে আমরা কী করবে?’

তানিলের লাশ ফেরত আনার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ওই ছেলেটির পরিবারের কেউ আমাদের বিষয়টি জানায়নি। স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জেনে আমরা ঢাকায় জানিয়েছি। এখনো তো লাশের অবস্থানই শনাক্ত করা যায়নি। ফলে কিভাবে লাশটি আনা হবে তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। এর আগে যারা মারা গেছে তাদের লাশও কিন্তু ফেরত আনা যায়নি। তারপরও আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করব লাশটি আনার জন্য।’

যে শাহীন মিয়ার মাধ্যমে তানিল ইরানে গেছে, সেই শাহীন মিয়ার মোবাইল ফোনটি বন্ধ। কোনোভাবেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এজন্য তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এর আগে গত ৭ মার্চ মানবপাচারকারীদের প্রতারণায় সার্বিয়ার রাস্তায় প্রাণ যায় বাংলাদেশী তরুণ বাদল খন্দকারের (৩০)। বাদল মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার নূর মোহাম্মদের ছেলে। ছয় লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে বাদল মেসার্স নূরজাহান রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র নিয়ে ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর সার্বিয়া যান। চুক্তি ছিল সার্বিয়াতে কোম্পানির কাজ দেবে। বাদল সেখানে গিয়ে ২৫ দিন কাজও করেছেন। এরপর কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। হতাশায় দিন কাটে বাদলের। বাঁচার তাগিদে বাদল সার্বিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্য রওনা দেন। তীব্র ঠান্ডায় অসুস্থ্ হয়ে পথেই মৃত্যু হয় বাদল খন্দকারের।

জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র নিয়ে যাওয়ার কারণে বাদলের লাশ সরকারি উদ্যোগেই দেশে এসেছে। বাদলের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমি মামলা করেছিলাম। সেই মামলায় নূরজাহান এজেন্সির মালিককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তারা তিন লাখ টাকা দেয়ার শর্তে সমঝোতা করেছিল। এক লাখ টাকা দিয়েছে। আর মামলা নিষ্পত্তি হলে দুই লাখ টাকা দেবে। এছাড়া সরকারের তরফ থেকে তিন লাখ টাকা পেয়েছি। এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে কষ্টেই দিন চলছে।’

শাহনাজ জানান, একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেছেন। বাচ্চা দু’টিকে মানুষ করার জন্য শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে সাভারে বাবার বাড়িয়ে থাকছেন তিনি।

বাদলের লাশ দেশে ফিরলেও গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক সীমান্তে মারা যাওয়া নজরুল ইসলাম শাহীনের লাশ দেশে আসেনি। স্বপ্নের হাতছানিতে অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশ করতে গিয়ে ২৮ বছরের তরুণ শাহীনের মৃত্যু হয়েছে। তুরস্ক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গ্রিসে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন শাহীন। তার বাড়ি ফেনীতে। তিনি ওমান থেকে তুরস্ক হয়ে ইউরোপ প্রবেশ করতে গিয়ে তীব্র তুষারপাতের কবলে পড়ে মারা যান। তিনি ফেনী পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বারাহীপুর এলাকার মাস্টারবাড়ির মিজানুর রহমানের ছেলে। ফেনীর শহীদ মেজর সালাহ উদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পাস করেন। ২০১৯ সালে জীবিকার তাগিদে তিনি দেশ ছেড়ে ওমান যান। দুই বছর ওমানে থাকার পর তিনি গত বছর তুরস্কে যান। সেখান থেকে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন। গ্রিসে প্রবেশের সময় তুষারপাতের কবলে পড়েন। তীব্র শীত ও খোলা আকাশের নীচে টানা দীর্ঘসময় থাকার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই ধরনের অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করতে হলে শুধু একটা রাষ্ট্রের উদ্যোগ নিলেই হবে না। এটা একটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার। যৌথ প্রচেষ্টা দরকা। আমাদের সরকার চাইলে কিছু উদ্যোগ নিতে পারে। এরা তো অনেকেই এয়ারপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আমাদের ইমিগ্রেশন পুলিশ আছে। যাদের দেশী-বিদেশী প্রশিক্ষণ আছে, তারা তো কারো সাথে দুই মিনিট কথা বললেই বুঝতে পারবে। হ্যাঁ, তার যদি বৈধ কোনো ভিসা থাকে সেটার পরও তো তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। এখানে সরকারি পর্যায় থেকে এদের সচেতন করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।’

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই অবৈধ চেষ্টা বন্ধে আমাদের দুটো জিনিস দেখতে হবে। এই যে ছেলেগুলো যায় তারা তো এই রাস্তা বের করতে পারে না। কতগুলো দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগী তাদের এই রাস্তায় নিয়ে যায়। এই দালালদের বিরুদ্ধে কী আমরা কখনো কোনো ব্যবস্থা নিয়েছি? একজনকেও শাস্তির আওতায় আনতে পেরেছি? না। তাদের শাস্তির আওতায় আনার দায়িত্ব কার? রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তো সেটা করছে না। তাহলে অন্যরা এটা দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন। ওদেরও শাস্তি হয়নি, আমারও হবে না’।

তার মতে, ‘দ্বিতীয় ব্যর্থতা হলো রাষ্ট্রের ভূমিকা দেখে মনে হয়, যাচ্ছে তো যাক না। তবুও তো যাচ্ছে। যেতে থাকুক। যত যায় ততই ভালো। তারা গিয়ে কী বিপদে পড়লে সেটা নিয়ে রাষ্ট্র অতটা চিন্তিত না। পরে দেখা গেছে, ইউরোপের সাথে চুক্তি করেও আমরা অবৈধদের ফেরত আনতে গড়িমসি করেছি। পরে কিছু একটা করায় বাজে রকমের যে নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনা ছিল সেটা আর হয়নি। আসলে তো এই পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া উচিত ছিল না।’

গত বছরের ঠিক এই সময় ২৫ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে সাত বাংলাদেশী তরুণ প্রাণ হারান। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে তখন বলা হয়েছিল, অবৈধভাবে তারা নৌকাযোগে লিবিয়া থেকে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। ঠান্ডায় তারা প্রাণ হারিয়েছেন।

এক বিবৃতিতে ইতালির আগ্রিজেন্তোর প্রসিকিউটর লুইগি প্যাত্রোনাজিও বলেন, ঠান্ডায় শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমে আসায় ওই বাংলাদেশীরা প্রাণ হারিয়েছেন৷ তাদের কারো লাশ তখন দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হয়নি।

ব্র্যাকের অভিভাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমাদের দেশের আট থেকে ১০ জেলার মানুষের কাছে ইউরোপে যাওয়া স্বপ্নযাত্রা। আমরা এটাকে বলি মৃত্যুযাত্রা। এভাবে যেতে গিয়ে কত মানুষ মারা গেছেন, কত মানুষ বন্দী হয়েছেন সেটার তো শেষ নেই’।

তিনি জানান, ‘গত একযুগে পরিসংখ্যান যে আমরা ইউরোপের কাছ থেকে পেয়েছি তাতেই দেখা যাচ্ছে, ৬৫ হাজার মানুষ ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে চিহ্নিত হয়েছেন বা আটক হয়েছেন। এখানে তো বছরের পর বছর পাচারকারী চক্র গড়ে উঠেছে। সবগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তো এটা নিয়ে কাজ করে। কিন্তু সমন্বিত কোনো অভিযান, সেটা বছরজুড়ে হচ্ছে না। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। সবাই মিলে চেষ্টা করলেই এই মৃত্যুযাত্রা থামানো সম্ভব।’

সূত্র : ডয়েচে ভেলে

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com