বৃহস্পতিবার, ০৫:১১ অপরাহ্ন, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।
শিরোনাম :

শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষা সময়ের দাবি

ডা. মো: মিজানুর রহমান
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২
  • ১০৭ বার পঠিত

বাদশাহ আলমগীর
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লির।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
কবি কাজী কাদের নেওয়াজ ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।

এতে তিনি বলছেন, একদিন বাদশাহ দেখলেন, তার সন্তান শিক্ষকের চরণে শুধু পানি ঢেলে দিচ্ছে। এটি দেখে বাদশাহ শিক্ষককে ডেকে পাঠালেন। শিক্ষক ভয়ে অস্থির, বাদশাহর ছেলেকে দিয়ে চরণে পানি ঢালার সেবা নিয়েছেন। গর্দান বুঝি যায় এবার। কিন্তু তিনি শিক্ষককে ডেকেছিলেন, কারণ বাদশাহ আলমগীর প্রত্যাশা করেছিলেন, তার সন্তান নিজ হাতে শিক্ষকের চরণ ধুয়ে দেবে। তবেই না তার সন্তান নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম নিয়ে দেশের একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। শিক্ষকের প্রতি সন্তানের এটুকু অবহেলাও মেনে নিতে পারেননি বাদশাহ আলমগীর। শিক্ষা হলো একটি জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষক হলেন তার কাণ্ডারি। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর মধ্যে যে বীজ বপন করেন তার মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতিনৈতিকতা ও জীবনাদর্শের বলয়ে একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত এবং কর্মময় জীবনকে মুখরিত করে তোলে যার মাধ্যমে একজন শিক্ষক নীরবে তার আদর্শ দিয়ে জাতির আকাক্সক্ষা উপযোগী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলেন।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি, শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো, সবার সামনে জুতার মালা পরানো, পায়ে হাত দিয়ে মাফ চাইতে বাধ্য করা, জেলে পাঠানো এমনকি পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনা হচ্ছে আমাদের সমাজে।

বর্তমানে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের সুসম্পর্ক অনেকটাই কমে গেছে। শিক্ষকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে এখনকার শিক্ষার্থীদের বুক কাঁপে না। নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে আছি আমরা।

অথচ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শিক্ষকরা হলেন পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। শিক্ষকতা শুধুই পেশা নয়, একটি মহান ব্রত। শিক্ষক শব্দটির সাথে জ্ঞান, দক্ষতা, সততা, আদর্শ, মূল্যবোধ শব্দগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন শিক্ষক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনে ভ‚মিকা রাখেন। শিক্ষকদের অমর্যাদা করে একটি জাতি কখনোই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ শিক্ষকরাই একটি জাতির মূল চালিকাশক্তি। একজন শিক্ষক তার জ্ঞান, দক্ষতা, সততা, আদর্শ ও মূল্যবোধের দিয়ে একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলেন। শিক্ষকের অপমান ও অশ্রদ্ধা কোনো জাতির জন্যই মঙ্গলজনক নয়। এভাবেই যদি শিক্ষকের অমর্যাদা চলতে থাকে তাহলে শিক্ষকদের মাঝে গুণগত শিক্ষা দেয়ার তাগিদ, শক্তি কিংবা সদিচ্ছা কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ হতে পারে তার আন্দাজ করা যায় নিচের ছোটগল্প থেকেই-

‘বহুদিন আগে কোনো এক নিরক্ষর গ্রামে কোথা থেকে এক শিক্ষক এসে শিশুদের পড়ানো শুরু করলেন। একদিন সেই গ্রামের বুদ্ধিমান মাতবর ভাবলেন, ওই ব্যাটা মাস্টার তো অসহায় বলেই এখানে এসেছে, ওকে এত বেতন দিয়ে কী হবে! বেতন কমিয়ে দিলেন। দেখলেন, কোনো অসুবিধা নেই। ও আছে, পড়াচ্ছে। তাহলে তো আরো কমানো যায়; কমালেন। তা-ও যায় না! এরপর মাতবর ভাবলেন, ওকে আসলে বেতন না দিলেও হবে। চাল, ডাল, লাউ, মুলা দিলেই ওর দিব্যি চলে যাবে। তা-ও চলল কিছুদিন। কিন্তু একদিন হঠাৎ সেই শিক্ষক উধাও। কী আর করা, অন্য এক শিক্ষককে ধরে আনা হলো। তিনি একদিন পড়িয়েই আগের শিক্ষক যে বেতন পেতেন তার তিনগুণ দাবি করে বসলেন। কেন? কারণ এ গ্রামের শিশুরা সব অক্ষর উল্টো করে লিখে। আগের শিক্ষক এভাবেই নীরবে তার অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে গেছেন।’ শিক্ষকরা ফেরেশতা নন। একেবারে শেষ সম্বল না হোক, তাদের সবচেয়ে বড় যে সম্বল, সেই সম্মান যদি তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়, তাহলে এ ধরনের প্রতিশোধ নেয়ার অপরাধ তারা করতেই পারেন।

একসময় শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সম্পর্ক কতটা শ্রদ্ধাময় ছিল তা সবারই জানা। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের সুসম্পর্ক অনেকটাই কমে গেছে। তবে এর দায় যেমন বর্তমান সমাজব্যবস্থার আছে, তার কিছুটা আমাদের শিক্ষকদেরও আছে। সব শিক্ষক নন, তবে কিছু কিছু শিক্ষকের কারণে আজ পুরো শিক্ষকসমাজ অপমানিত হচ্ছে, অপদস্থ হচ্ছে। ছাত্রীদের যৌন হয়রানি, শ্রেণিকক্ষে সঠিকভাবে পাঠদান না করিয়ে প্রাইভেটে কিংবা কোচিংয়ে পাঠদান করাসহ নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত থাকেন কিছু কিছু শিক্ষক।

শিক্ষকরাও এ সমাজেরই মানুষ, সুতরাং কিছু সীমাবদ্ধতা থাকাটাই স্বাভাবিক। আমাদের উচিত যেমন শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান করা তেমনি শিক্ষকদেরও উচিত শাসন, আদর, নৈতিকতা, আদর্শের পাশাপাশি রেখে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়া।

কালে কালে বিখ্যাত ব্যক্তিরা তাদের শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন। ইমামে আজম আবু হানিফা রহ. শিক্ষকের প্রতি তার শ্রদ্ধার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার শিক্ষক ইমাম হাম্মাদ রহ. যতদিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন আমি তার বাড়ির দিকে পা মেলে বসিনি। আমার মনে হতো, এতে যদি শিক্ষকের প্রতি আমার অসম্মান হয়ে যায়।’

স্বভাবতই শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মায়ের চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। মহান আল্লাহ তায়ালাও শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছেন। ফলে মুসলিম সমাজে শিক্ষকমাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী।

মহানবী সা: ঐশী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানবজাতিকে সৃষ্টিকর্তা, মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের নীতিমালা শিক্ষাদান করেছেন। তিনি নিজেই এ পরিচয় তুলে ধরে ঘোষণা করেছেন, ‘শিক্ষক হিসেবে আমি প্রেরিত হয়েছি’। (ইবনে মাজাহ-২২৫)। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞানার্জন করো ও জ্ঞানার্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শিখো এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞানার্জন করো, তাকে সম্মান করো।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও শিক্ষকদের সম্মানের চোখে দেখতেন। শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অগাধ শ্রদ্ধার কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক আবুল ফজল লিখেছেন- ‘ঊনসত্তরের নভেম্বর মাসে ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘শক্ত কেন্দ্র কেন ও কার জন্য’ শিরোনামে প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে বঙ্গবন্ধু অভিনন্দন জানিয়ে তাকে পত্র লিখেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর পত্রের জবাবে অধ্যাপক আবুল ফজল যে পত্র লিখেছিলেন তার উত্তরে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন- ‘আপনার মতো জ্ঞানী, গুণী ও দেশপ্রেমিকের সাথে দেখা করতে পারলে খুবই আনন্দিত হতাম। আবার যখন চট্টগ্রামে যাব, সাহিত্য নিকেতনে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনার সাথে দেখা করব।’ অধ্যাপক আবুল ফজলকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফোন করে বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক আবুল ফজলের অনুমতি নিয়েছিলেন বলে তিনি লেখায় উল্লেখ করেছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান প্রফেসর ইন্নাস আলী স্মৃতিচারণায় লিখেছেন- ‘বঙ্গবন্ধু উপাচার্যদের প্রায়ই ডাকতেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত চাইতেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব সম্মান দেখাতেন। ওনার রুমে ঢুকলেই দাঁড়িয়ে যেতেন। অনেক সময় হয়তো মিটিং চলছে তখনো এ রকম দাঁড়িয়ে সম্মান করতেন।’

শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি মধ্য দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি, দেশব্যাপী শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষা এবং শিক্ষকদের জীবনের মান উন্নত করার ব্যাপারে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। একজন শিক্ষক নিজের জ্ঞান-গরিমা, চলন-বলন, নীতিনৈতিকতায় শুধু নয়, সমাজের দৃষ্টিতেও যত উঁচুতে উঠবেন, তিনি তত বড় শিক্ষক হবেন। এত দিন তাই হয়ে আসছে, ভবিষ্যতেও তাই হবে। এটি জানতেন বলেই কবি কাদের নেওয়াজ তার ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায় লিখেছিলেন-
‘উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্নিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’

সত্যিকারভাবে একজন আদর্শ শিক্ষকই পারেন তার জ্ঞানের আলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজকে আলোকিত করতে। দেশ ও জাতি গঠনে একজন শিক্ষকের ভ‚মিকা অপরিসীম। শিক্ষকের মর্যাদা সবার উপরে। তাই আমাদের উচিত আমাদের শিক্ষাগুরুদের মন থেকে সম্মান করা, তাদের মন থেকে ভালোবাসা। আমি আমার সব শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই, যারা আমার শিক্ষাজীবনে আমাকে সর্বদা অনুপ্রাণিত করেছেন। সেই সাথে আমি শ্রদ্ধা জানাই দেশের সব স্তরের শিক্ষকদের প্রতি, যারা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জাতির ভবিষ্যতের মজবুত ভিত্তি গঠনে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

লেখক : চিকিৎসক, ইউনাইটেড হাসপাতাল, ঢাকা

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com