অন্য ভাষায় :
শুক্রবার, ১০:৪১ পূর্বাহ্ন, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

ব্রিটেনে কারিশিল্পের এক পথিকৃতের প্রতি শ্রদ্ধা

সাঈদ চৌধুরী
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২০ জুলাই, ২০২২
  • ৮০ বার পঠিত

কারি কিং হিসেবে পরিচিত কারি অস্কারখ্যাত ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের প্রতিষ্ঠাতা এনাম আলী এমবিই গত রোববার (১৭ জুলাই) ইন্তেকাল করেছেন।

এনাম আলী এমবিই ব্রিটেনে কারিশিল্পের একজন পথিকৃৎ। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, থেরেসা মে ও বরিস জনসনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও ব্রিটেনের মূল ধারায় একজন প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন সময় বিবিসি, চ্যানেল ফোর, সিএনএন, আলজাজিরাসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তার অভিমত কারি ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে খুবই অর্থবহ এবং সময়ের দাবি পূরণে সহায়ক হয়েছে।

এনাম আলী এমবিই ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সরকারের হসপিটালিটি অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় কারি ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট ইমিগ্রেশন নীতিমালা সুষ্ঠু করার ব্যাপারে তিনি সর্বাত্মক ভূমিকা রাখেন। তার প্রস্তাব নিয়ে হাউজ অব কমন্সে জমজমাট বিতর্ক হয়েছে। সাম্প্রতিক বিন্দালু ভিসা চালুর প্রক্রিয়ায়ও তার সরব ভূমিকা অভিবাসীদের কাছে প্রশংসিত।

লন্ডন আসার আগে ব্রিটিশ কারি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যখন লেখালেখি করেছি, তখন মনে হয়েছিল সরেজমিন একটি বিশেষ প্রতিবেদন করা উচিত। সে সময় ব্রিটিশ অর্থনীতিতে এই ইন্ডাস্ট্রির অবদান ছিল প্রায় তিন বিলিয়ন পাউন্ড। বর্তমানে কারি ইন্ডাস্ট্রির অবদান ৪.৩ বিলিয়ন পাউন্ড দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের কারণে হয়তো সামান্য ব্যত্যয় ঘটতে পারে। এতবড় একটা ইন্ডাস্ট্রির বেশির ভাগের মালিক ব্রিটিশ বাংলাদেশী। এটি একটি বিশাল ব্যাপার এবং এর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্ব সহজ বিষয় নয়।

২০০০ সালের ৪ আগস্ট শুক্রবার ব্রিকলেন আলাদিন রেস্টুরেন্টে সাংবাদিক স্টিভ টার্নারসহ আমরা কয়েকজন বসে খাচ্ছি। স্টিভ আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশী ও ইন্ডিয়ান খাবারের তফাৎ জানতে চান। আমি তাকে এই রেস্টুরেন্টসহ ইন্ডিয়ান বলতে যে মূলত বাংলাদেশী খাবার, তা বুঝাতে চেষ্টা করি। তখন তার প্রশ্ন ছিল, তাহলে এগুলোর নামে ইন্ডিয়ান যুক্ত কেন?

স্টিভ একজন সাংবাদিক নেতা। অ্যাসোসিয়েশন অব জার্নালিস্টস (বিএজে)-এর জেনারেল সেক্রেটারি। যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত ছাড়া তাকে সহজভাবে বুঝানো বেশ কষ্টকর ছিল। স্টিভকে বিদায় দিয়ে আমি টেলিফোন করি ব্রিটেনের কারি কিং খ্যাত এনাম আলী এমবিইকে। তিনি তখন কয়েকজন স্বদেশী নিয়ে ডাইন বাংলাদেশী ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছেন। বিষয়টি শুনেই তিনি লুফে নিলেন এবং টেলিফোনে একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। এ বিষয়ে তার গভীর ভাবনা ও আন্তরিকতা মুগ্ধ করে। এনাম আলী জানালেন, বিবিসির জাস্ট ফর দ্য জব ডকুমেন্টরি অনুষ্ঠানে জেম্স ওয়েলের এক প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ডাইন বাংলাদেশী ক্যাম্পেইন শুরু করেন। কমিউনিটি নেতা আব্দুল মোহাইমিন মিয়া, আজিজুর রহমান, মৌলা মিয়া, সাইদুর রহমান রেনু, মোহাম্মদ আফসার ওয়েস, ফয়সল চৌধুরী, আনা মিয়া প্রমুখ এই আন্দোলনের সূচনা থেকে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৯২ সালে কেনারি ওয়ার্ফের ব্রিটানিয়া হোটেল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের যাত্রা শুরু হয়।

প্রায় দুই বছর প্রচার তৎপরতা চালিয়ে ১৯৯৪ সালে এটিকে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসেন। তখন থেকে নাম হয় গিল্ড অব বাংলাদেশী রেস্টুরেটার্স। এর জন্মানুষ্ঠানে তৎকালীন ফুড মিনিস্টার আঞ্জেলা ব্রাইন আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। সেন্ট্রাল লন্ডনের অভিজাত ভেন্যু দ্যা গভর্নর হাউজ পাকলেইন হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আঞ্জেলা পুরো বিষয়টি অবহিত হয়ে এর স্বপক্ষে তার অভিমত ব্যক্ত করেন।

ব্রিটেনে তখন আমাদের প্রায় সব রেস্টুরেন্ট ইন্ডিয়ান নামে পরিচিত ছিল। প্রথম যারা এ দেশে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালু করেন তারা অখণ্ড ভারতের নাগরিক হিসেবে খুব স্বাভাবিক কারণেই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নাম দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান হলেও প্রতিষ্ঠিত রেস্টুরেন্টের নাম বদলের চিন্তা বা সাহস কেউ করেননি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হওয়ার পরও আগের ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। ডাইন বাংলাদেশী ক্যাম্পেইন এ ক্ষেত্রে নব জাগরণের সৃষ্টি করে এবং এনাম আলী হলেন এর প্রাণপুরুষ।

একসময় বাংলাদেশী কুইজিন হিসেবে নাম বদলের ব্যাপারে গিল্ড অব বাংলাদেশী রেস্টুরেটার্সের সরব প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে। পরে বিলেতের বাংলা মিডিয়া বিশেষ করে ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি ও ইউকে এশিয়ান রেস্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি এবং বিসিএ, বিবিসিসির বহুমুখী প্রয়াস উল্লেখের দাবি রাখে। আজকে গর্বের সাথে বলা যায়, এই প্রচার তৎপরতা যথেষ্ট সফল হয়েছে। মূল ধারার মিডিয়া ও ব্রিটিশ জনগণ বাংলাদেশী খাবার সম্পর্কে এখন যথেষ্ট সচেতন।

২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার সম্পাদিত মাসিক সময়ে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট ইন্ডিয়ান হয়ে আর কতকাল? শীর্ষক কভার স্টোরি করি। ১৩ ডিসেম্বর ব্রিটেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনপ্রিয় রাজনীতিক রবিন কুক পূর্ব লন্ডন সফরে আসেন। তার সাথে ছিলেন বেথনাল গ্রীন অ্যান্ড বো আসনের এমপি উনা কিংসহ লেবার পার্টির নেতারা। এ সময় আনুষ্ঠানিকভাবে মাসিক সময় তাকে প্রদান করলে তিনি শীর্ষ প্রতিবেদন রেস্টুরেন্ট প্রসঙ্গ অবহিত হয়ে বলেন, ২০০১ সালে চিকেন টিক্কা মাসালাকে ব্রিটিশ জাতীয় খাবার হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। অবশ্য এটা শুনে অনেকেই তখন অবাক হয়েছিল বলেও তিনি জানান।

এনাম আলী এমবিই ব্রিটেনের রাজনীতিতে আমাদের কমিউনিটির স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। মার্গারেট থ্যাচারের সময় থেকে তিনি কনজারভেটিভ পার্টির সাথে সক্রিয় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ডেভিট ক্যামেরনের একজন ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সাথেও ছিল সখ্য। তিনি টেরাকিউ লিমিটেডের উপদেষ্টাদের একজন। প্রতিষ্ঠানটি জাতিসঙ্ঘের সাথে কাজ করছে। এর আগে তিনি ইউনাইটেড নেশন্সে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট (এডুকেশন)-এর সদস্য ছিলেন।

কারি কিং এনাম আলী ২০০৫ সালে ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটেনের কারি ইন্ডাস্ট্রিতে এটাই ছিল প্রথম এবং নতুন প্রজন্মের উপযোগী কারি অ্যাওয়ার্ড। করোনাকালের আগে অস্কারখ্যাত ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের ১৫তম রাজকীয় আয়োজন ছিল ২৫ নভেম্বর ২০১৯ । ব্রিটিশ জিনিয়াস সাইটে বাটার্সি পার্কের দৃষ্টিনন্দন ভেন্যুতে হয়েছে এটি। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড উইনার আয়োজকদের আন্তর্জাতিক মানের পরিকল্পনা মোতাবেক সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। মান ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অনুষ্ঠানস্থলে চলে সপ্তাহব্যাপী রিহার্সেল। অ্যাওয়ার্ডের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণকারীদের না জানিয়ে রেস্টুরেন্টগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছেন জুরি বোর্ডের সদস্যরা। নানারকম নান্দনিকতার মিশেলে সাজানো এসব রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশনা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, হেল্থ অ্যান্ড সেইফটি ইত্যাদির রকমফের তলিয়ে দেখেছেন তারা।

ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের ফাউন্ডার এনাম আলী এমবিই, তার মেয়ে জেস্টিন আলী ও ছেলে জেফরী আলী একের পর এক আইডিয়া উদ্ভাবন করেন তাদের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় নতুনত্ব সৃষ্টির জন্য। দেড় যুগ ধরে এনাম আলী কারিশিল্পকে একটি অভিজাত শিল্পে পরিণত করার লক্ষ্যে বহুমুখী প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন। তাই তাকে বলা হয় আধুনিক কারিশিল্পের অগ্রদূত। আর ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড এখন অস্কারখ্যাত। রাজকীয় এই অনুষ্ঠানগুলোতে ব্রিটেনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের তিনজন প্রধানমন্ত্রী, মূল ধারার সাংবাদিক, খ্যাতিমান ব্যবসায়ী, টিভি ও ফিল্ম ব্যক্তিত্ব, ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য, পার্লামেন্ট সদস্য এমনকি মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা আগ্রহ ভরে অংশগ্রহণ করেছেন।

আইটিএন নিউজ প্রডাকশনের অনুসন্ধানে সারা বিশ্বে ৪৩৪ মিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছা ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডে ব্রিটেনের সেরা রেস্টুরেন্টগুলোকে ১১টি রিজিওনে পুরস্কৃত করা হয়। প্রায় ৮ ঘণ্টার এ আসরে ছিল বিশ্বমানের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন থিম সামনে রেখে অনুষ্ঠান সাজানো হয়। ইন্টারন্যাশনাল কোরিওগ্রাফার জাস্টিন আলীর তত্ত্বাবধানে বিশ্বমানের লাইভ এন্টারটেইনমেন্টসহ নতুন অনেক কিছু দেখা গেছে প্রতিটি কারি অ্যাওয়ার্ডে।

ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স বিবিসিসি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট এনাম আলী এমবিই ১৯৯১ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত বিবিসিসি’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকদের একজন। বাংলাদেশের সাথে ব্রিটেনের বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ সম্পর্ক উন্নয়নে এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের শিকড়ের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বিবিসিসি’র প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বাংলাদেশে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এনআরবি দিবস উদযাপন করেছেন। অনুষ্ঠানটি সফল করতে আমি তাকে সার্বিক সহায়তা করেছি।

এনাম আলী এমবিই ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য লন্ডন আসেন। এখানে বিভিন্ন সময় ছোটখাটো কাজ করে লেখাপড়া করেন। পরে নিজের রেস্টুরেন্ট চালু করেন। ব্রিটেনে কারিশিল্পে কিংবদন্তিতুল্য এই পথিকৃৎ অসংখ্য মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। আমরা মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।

লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com