মঙ্গলবার, ০৫:১১ অপরাহ্ন, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

গণভোটে বিভাজনের ঝুঁকি এড়ানোর উপায় কী

বুলবুল সিদ্দিকী
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫
  • ৯ বার পঠিত

রাজনৈতিক দলগুলো যখন নিজেদের ভেতর একধরনের টানাপোড়েন ও আস্থাহীনতার সংকটে ভুগছে, তখন জুলাই সনদের মধ্য দিয়ে একটি ঐকমত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য আশার আলো দেখায়। প্রস্তাবিত বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কার, জবাবদিহি এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নপ্রক্রিয়ার জন্য জুলাই সনদ একটি কার্যকর দলিল হিসেবে রাজনৈতিক দল ও জনগণের সামনে থেকে যাবে।

জুলাই সনদ তৈরির অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো দলীয় প্রভাবমুক্ত মানবিক রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা। তাই জুলাই সনদের গুরুত্ব বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একে কেন্দ্র করে জনগণের ম্যান্ডেট বা সমর্থন পাওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে গণভোটের প্রস্তাব সামনে আসে।

গণভোটের মধ্য দিয়ে যদি জুলাই সনদের বৈধতা নিয়ে আসা যায়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর এই সনদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা ভবিষ্যতের জন্য অনেক সহজ হয়ে উঠতে পারে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতি একভাবে দায়বদ্ধ থাকবে, যেখানে জনগণ বলতে পারবে যে জুলাই সনদকে সরাসরি তারাই বৈধতা দিয়েছে। এতে করে জনগণের অংশগ্রহণ রাষ্ট্রীয় পরিসরে বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থাশীল হতে শুরু করবে যে রাজনৈতিক আস্থা বিগত সময়ে আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনুপস্থিত ছিল।

রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে আস্থা এবং জবাবদিহিমূলক সম্পর্ক তৈরির জন্য গণভোট কার্যকর মাধ্যম হতে পারে। গণভোট হচ্ছে জনগণের বৈধতা পাওয়া ও আস্থা অর্জন করার একটি কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, সেটি আমরা বিগত সময়ে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত কয়েকটি গণভোটে দেখেছি; যদিও এর মধ্যে বিতর্কিত গণভোটের উদাহরণও রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যদি এটিকে সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। যদিও কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন যে গণভোটের মাধ্যমে জনমনে আরও বিভাজনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

এসব কারণে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোটের প্রস্তাব সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক মহলে বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গণভোট আয়োজনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ও আইনগত সীমাবদ্ধতার কথা যেমন আসছে, তেমনি গণভোট আয়োজন করার প্রক্রিয়া নিয়েও ভিন্নমত দেখা দিয়েছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো যেমন ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে, তেমনি জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি প্রস্তাব করছে নির্বাচনের আগেই গণভোট করার। যদিও এনসিপি আগে বলেছিল যে তারাও জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে।

গণভোটে বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন দেশে ‘হ্যাঁ ‘বা ‘না’ বিকল্পের মাধ্যমে ভোট নেওয়া হয়ে থাকে। তবে অনেক সময় এখানে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে দুইয়ের অধিক বিকল্প থেকেও জনগণকে একটি বেছে নিতে হয়। গণভোট আয়োজনের ক্ষেত্রে সব সময় মাথায় রাখতে হয়, এটি যেন জনগণের জন্য সহজ ও বোধগম্য হয়। তাই সাধারণত গণভোটের সময় একাধিক প্রশ্নের অবতারণা করা হয় না। কেননা, এটি সব শ্রেণি ও ধরনের ভোটারদের সুবিধা ও অসুবিধার কথা বিবেচনা নিয়ে করা হয়।

তবে এমন তাড়াহুড়া করে গণভোট আয়োজন করা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, সেটি আমাদের সতর্কভাবে ভেবে দেখতে হবে। কেননা, এখানে বেশ কয়েকটি সীমাবদ্ধতার বিষয় আমরা উল্লেখ করতে পারি। প্রথমত, জুলাই সনদ নিয়ে জনগণের মধ্যে যথাযথ জ্ঞান রয়েছে কি না, সেটি মূল্যায়ন করা। জনগণের মধ্যে যদি জুলাই সনদ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকে, তাহলে গণভোট আয়োজনের প্রধান যৌক্তিকতা বিফলে যাবে, যদি জনগণ এই গণভোটকে প্রত্যাখ্যান করে। এতে করে জুলাই সনদে স্থান পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যেতে পারে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করার জন্য আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। আবার গণভোটের জন্য নির্বাচন পেছানোর যুক্তি নিয়ে এলে দেশ আরও সংকটের মধ্যে পড়বে। তৃতীয়ত, জনগণকে প্রস্তুত না করে ও যথাযথ প্রচার না চালিয়ে গণভোট আয়োজিত হলে ভোটারদের উপস্থিতির সংখ্যা নিয়ে আশঙ্কা থেকে যেতে পারে, যেমনটি এ বছর জুনে ইতালিতে অনুষ্ঠিত শ্রম ও নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তনের গণভোটের সময় দেখা যায় যা গণভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

সে ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের সময় গণভোট আয়োজন করাই অধিক যুক্তিযুক্ত হবে। কেননা, এতে আলাদা করে গণভোট আয়োজনের খরচ করতে হবে না এবং শ্রম দিতে হবে না। ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগের এই সময়ে জুলাই সনদ নিয়ে জনগণকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য কিছুটা হলেও সুযোগ থাকবে, যার প্রভাব তাঁদের সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।

জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট আয়োজন করার বড় সুবিধাটা হলো, যেহেতু সারা দেশের মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ–উদ্দীপনা কাজ করে, ফলে সেখানে ভোটারের উপস্থিতি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। ফলে গণভোটের জন্যও অধিকসংখ্যক জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়াটা সহজ ও যুক্তিসংগত হবে।

জুলাই সনদের মতো সংস্কারমূলক নীতি সাধারণ নাগরিকদের কাছে জটিল বিষয় মনে হতে পারে। কেননা, জুলাই সনদ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চললেও সাধারণের মধ্যে জুলাই সনদবিষয়ক বিস্তারিত ধ্যানধারণা কতটুকু তৈরি হয়েছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তাই গণভোটের আগে জণগণকে প্রস্তুত করতে হবে এবং তার জন্য সময় প্রয়োজন। তাই জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত হলেই তড়িঘড়ি করে গণভোট করা উচিত হবে না।

যদি ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট করতে হয়, তাহলে গণভোটের আগে এই সনদের বিষয়গুলো নিয়ে জনপরিসরে বিস্তর আলোচনা ‍ও সচেতনতা গড়ে তোলার কিছুটা সময় পাওয়া যাবে, যা খুব জরুরি। তাই গণভোট আয়োজনের আগেই এ বিষয়ে জনগণকে যথাযথভাবে সজাগ করতে হবে। সেটি না করা হলে গণভোটের ন্যায্যতা নিয়ে পরবর্তীকালে প্রশ্ন উঠতে পারে।

গণভোটে বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন দেশে ‘হ্যাঁ ‘বা ‘না’ বিকল্পের মাধ্যমে ভোট নেওয়া হয়ে থাকে। তবে অনেক সময় এখানে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে দুইয়ের অধিক বিকল্প থেকেও জনগণকে একটি বেছে নিতে হয়।

গণভোট আয়োজনের ক্ষেত্রে সব সময় মাথায় রাখতে হয়, এটি যেন জনগণের জন্য সহজ ও বোধগম্য হয়। তাই সাধারণত গণভোটের সময় একাধিক প্রশ্নের অবতারণা করা হয় না। কেননা, এটি সব শ্রেণি ও ধরনের ভোটারদের সুবিধা ও অসুবিধার কথা বিবেচনা নিয়ে করা হয়।

যেহেতু আমাদের দেশের ভোটারদের গণসচেতনতা এবং জুলাই সনদ সম্পর্কে জানাশোনার পরিধি এখনো কম, তাই গণভোট কেবল জুলাই সনদের সঙ্গে একমত হওয়া বিষয়াবলির বাস্তবায়নে তাঁদের একটি ম্যান্ডেট নেওয়ার প্রক্রিয়া যা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না ‘ভোটের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। তবে এখানে জটিলতা হলো, যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি, সেসব বিষয়কে কীভাবে দেখা হবে, তার রূপরেখা গণভোটের মাধ্যমে তুলে আনা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায় একটি অসম্ভব বিষয়।

তাই জুলাই সনদের বাস্তবায়নের বিস্তারিত রূপরেখা প্রণয়নের বিষয়টি পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই সমীচীন হবে। নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সংসদে বিশদ আলোচনার মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা গড়ে তোলার জন্য সর্বদলীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা হবে বাস্তবসম্মত প্রক্রিয়া। এটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় হওয়ার কারণে জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি পাবে। আর সেটি করা গেলে ভবিষ্যতে জনগণের মধ্যে এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিভাজনের ঝুঁকিও এড়ানো সম্ভব হবে।

  • বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com