হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার শাহজাহান চৌধুরী ১৪ বছর যাবত লন্ডন প্রবাসী হয়েও বৈষম্যবিরোধী মামলায় অভিযুক্ত আসামি হয়েছেন। অথচ যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানোর পর সর্বশেষ ২০১১ সালে দেশে এসেছিলেনশাহজাহান চৌধুরী। তারপর আর আসা হয়নি দেশে।
জানা যায়, উপজেলার ২নং আহম্মদাবাদ ইউনিয়ন বগাডুবি গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান ছাত্রজীবনে ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি হিসেবে ও যুক্তরাজ্যের কোভেন্ট্রি বিএনপির সাবেক এই সদস্য সচিবের নেতৃত্বে দেন।
এর মাঝেই শেষবার ছেলের মুখ দেখতে না পারার আক্ষেপ নিয়েই মারা যান তার মা।
অথচ ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রবাসী শাহজাহান চৌধুরীকে।
মামলার এজাহার ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই জুমার নামাজের পর সিলেট কালেক্টরেট মসজিদ থেকে বেরিয়ে স্থানীয় একদল ছাত্র-জনতা বন্দরবাজার এলাকায় গিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন। ওই সমাবেশে উপস্থিত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানোর পাশাপাশি ঘটনাস্থলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নাশকতা সৃষ্টি করা হয়।
জানা যায়, ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন শাহজাহান চৌধুরী। ২০১১ সালের ১ মার্চ দেশে এসে ২৭ মার্চ ফিরে যান যুক্তরাজ্যে। এর পর গত ১৩ বছরের মধ্যে একবারও দেশে আসেননি তিনি। ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তার মা ও দুই বোনের মৃত্যু হয়। এর কোনোবারই ফিরতে পারেননি শাহজাহান। এসব তথ্য স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রতিবেশীরা নিশ্চিত করেন।
এদিকে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সিলেটের একটি ঘটনায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে শাহজাহানকে।
এ ঘটনায় ২৭ অক্টোবর দক্ষিণ সুরমার মানিকপুর এলাকার আকবর আলী নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। ১০০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরও ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করে দায়ের করা হয় এই মামলা। আসামির তালিকার ৭৬ নম্বর নামটি শাহজাহান চৌধুরীর। মামলায় উল্লিখিত সময় দেশে না থাকলেও ছাত্রদলের সাবেক নেতা শাহজাহান চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে এমন ‘গায়েবি মামলা’র জড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি সহজভাবে দেখতে নারাজ স্থানীয় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। তারা বলছেন, সুপরিকল্পিতভাবে প্রবাসী শাহজাহানকে আসামি করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাকে দ্রুত এ মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার পাশাপাশি এই কাজে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করারও দাবি জানান তারা। তা না হলে যেকোনো সময় দলের অন্য নেতাকর্মীও এমন সংকটে পড়তে পারেন।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এবং শাহজাহান চৌধুরীর পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ঘটনার সময় তার বাংলাদেশে না থাকার বিষয়টি পরিষ্কার হয়। অন্যদিকে সে সময়ই তিনি যে দেশে ছিলেন, তা পুলিশ বা মামলার বাদী নিশ্চিত করতে পারেননি। এমনকি মামলার বাদী আকবর আলী শাহজাহানের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেননি। সেক্ষেত্রে কীভাবে নাম উল্লেখ করে উনি শাহজাহানকে মামলার আসামি করেছেন, সেই প্রশ্নের কোনো উত্তরও দেননি তিনি।
এদিকে আমাদের সময় প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলার সময় আকবর আলী মামলার ৭৬ নম্বর আসামি শাহজাহান সম্পর্কে জানতে চাইলে কোনো কিছুই বলতে পারেননি। তিনি এখন খুব অসুস্থ বলে কল কেটে দেন।
সিলেট কোতোয়ালি থানার ওসি জিয়াউল হক এ ব্যাপারে আমাদের সময় প্রতিনিধিকে জানান, সরকার পতনের পর অনেক মামলা হয়েছে। প্রবাসে কেউ থাকাবস্থায় যদি মামলার আসামি হন, তদন্তে তেমনটা পাওয়া গেলে চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হবে। বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলেও জানিয়েছেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে শাহজাহান ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং হামলায় অংশ নিয়েছেন এমন কোনো তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।
এ বিষয় চুনারুঘাট থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মীর সিরাজ আলী এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘মা-বোন মারা গেলেন, সে সময়ই তাকে আমারা কেউ দেখিনি। শাহজাহান চৌধুরী প্রায় ১৩ বছর ধরে দেশেই নেই। তাহলে উনি কীভাবে হামলা করলেন? যতদিন ছাত্রদলের রাজনীতি করেছেন, তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগের কথা শোনা যায়নি।’
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা হলে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত শাহজাহান চৌধুরী আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতির নামে টেন্ডারবাজি, ভোগদখল, চাঁদাবাজিতে ছিলাম না কখনো। জীবিকার তাগিদে যুক্তরাজ্যে চলে আসি। ২০১১ সালে শেষবার দেশে যাই। এরপর আর যাওয়া হয়নি। নিজের মা-বোনের মুখও শেষবারের মতো দেখা হয়নি। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় এক ইউপি সদস্যের মাধ্যমে জানতে পারি, আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন পুলিশ আসামি খোঁজার নাম করে বাড়িতে গিয়ে আমার পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করছে।’
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তিনি কোথায় ছিলেন তা জানতে চাইলে শাহজাহান চৌধুরী জানান, মামলার এজাহারে ঘটনা সংঘটিত হওয়ার যে সময় ও স্থান উল্লেখ করা হয়েছে, সে সময় তিনি যুক্তরাজ্যের কোভেন্ট্রিতে অবস্থান করছিলেন। তার পাসপোর্ট ও কোভেন্ট্রি বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেও একই তথ্য জানা গেছে।
শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক জীবনে একজন পুরোপুরি ছাত্রনেতাই ছিলাম। সেই সঙ্গে ফুটবলে জাতীয় পর্যায়ের একজন উদীয়মান খেলোয়াড়ও। বিগত ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সঙ্গে আঁতাত করা স্থানীয় বিএনপির কিছু সুবিধাবাদী নেতার প্রতিহিংসার শিকার হই। যে কারণে রাজনীতির পাশ কাটাতেই সব ছেড়ে যুক্তরাজ্য চলে আসি। সেখানেও তাড়া করে বেড়াচ্ছে ভূতুড়ে মামলার হয়রানি।’
যুক্তরাজ্যের কোভেন্ট্রি বিএনপির সাবেক সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেন আমাদের সময় প্রতিনিধিকে বলেন, ‘শাহজাহান চৌধুরী যুক্তরাজ্যেই আছেন। আমার জানা মতে, তিনি ১৮ জুলাই বাংলাদেশে যাননি। আমরা সবসময় এক সঙ্গে চলি। একই এলাকায় একই সার্কেলে চলা প্রবাসীরা একে অন্যের পরিবারের সদস্যের মতো। তিনি এর মাঝে দেশে গেলে আমরা অবশ্যই জানতাম। আমিসহ এখানকার বিএনপি নেতাকর্মীকে তিনি জানিয়েছেন, তাকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে।’