গত কয়েক বছরের মতো এবারো প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে কোরবানির পশুর চামড়া ব্যবসার সর্বনাশ হয়েছে। সরকারিভাবে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হলেও সেই মূল্য কার্যকর হলো কি না তার তদারকি না থাকায় বিনিয়োগকারীরা সমূহ ক্ষতির শিকার হয়েছেন। অন্য দিকে গরিব মানুষ এবং দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো বঞ্চিত হয়েছে বছরের প্রত্যাশিত আয় থেকে।
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ঈদুল আজহার আগে সরকার কোরবানির পশুর চামড়ার যে দর নির্ধারণ করে দিয়েছিল সেই দরে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি বিক্রেতারা। আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারো নামমাত্র মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। এবার সরকারনির্ধারিত দাম অনুযায়ী ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ঢাকায় ১৮ থেকে ২০ টাকা, বকরির প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
গত রোববার কোরবানি শেষে বিভিন্ন স্থান থেকে নামমাত্র মূল্যে চামড়া সংগ্রহ করেছেন মৌসুমি ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা। দাম না থাকায় চামড়া নিয়েও তেমন আগ্রহ ছিল না মানুষের। গরু আর মহিষের চামড়া কিছুটা বিক্রি হলেও ছাগলের চামড়া বিনামূল্যেই সংগ্রহ করেছেন অনেকেই।
এক দশক আগেও ছোট আকৃতির গরুর চামড়ার দাম ছিল এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা। মাঝারি আকারের চামড়ার দাম এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা এবং বড় সাইজের চামড়ার দাম দুই হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। একই চামড়া এখন আকৃতিভেদে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ৪০০ টাকায়।
২০১৪ সালে বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি দামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছিল। তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের নির্দেশে চামড়া ব্যবসায়ীদের তিন সংগঠন বাংলাদেশ প্রস্তুত চামড়া, চামড়াপণ্য ও জুতা রফতানিকারক সমিতি (বিএফএলএলএফইএ), বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) এবং বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে ৭০-৭৫ টাকা। ঢাকার বাইরে দর ছিল ৬০-৬৫ টাকা। তবে শেষ পর্যন্ত কোরবানির ঈদের দিন পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় লবণবিহীন প্রতি বর্গফুট চামড়া বিক্রি হয় ৯০-১০০ টাকায়।
এর পরের আট বছর কোরবানির পশুর চামড়ার দাম দফায় দফায় কমেছে। কোনো বারই নির্ধারিত দামে চামড়া বেচাকেনা হয়নি। ২০১৯ সালে তো কোরবানির চামড়া নিয়ে একধরনের বিপর্যয় ঘটে যায়। দাম না পেয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চামড়া ফেলে দেন অনেকে। মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটে। তখন বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নানামুখী উদ্যোগ নেয়। গত দুই বছর বিপর্যয় না হলেও খুবই কম দামে চামড়া বিক্রি হয়। চলতি বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো: সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, আইএসও ও এলডব্লিউজি কমপ্লায়েন্ট সার্টিফিকেট না পাওয়ার কারণে ইউরোপে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা যাচ্ছে না। কেউ কেউ নানাভাবে লবির মাধ্যমে চীন, তাইওয়ান, কোরিয়া ও ইতালির মতো কয়েকটি দেশে এখনও রফতানি চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সেখানে প্রত্যাশিত দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এই দু’টি সংস্থার স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত চামড়া শিল্পে স্থিতিশীলতা আসবে না। দেশেও চামড়ার প্রকৃত মূল্য নিশ্চিত করা যাবে না। তিনি বলেন, সাভারে আমাদের যে শিল্পনগরী তা পুরোপুরি কমপ্লায়েন্ট হয়নি। কারণ শিল্পনগরীতে সিইটিপি হয়েছে। ডাম্পিং ইয়ার্ডও হয়েছে, কিন্তু এখনো সলিড ওয়েস্ট ডেস্ট্রয় ম্যানেজমেন্টের কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। এটাই আইএসও ও এলডব্লিউজির স্বীকৃতি না পাওয়ার অন্যতম কারণ। একে কমপ্লায়েন্ট করার মতো উদ্যোগ সরকার বা বিসিককেই নিতে হবে।
ক্রেতা নেই চামড়ার
চট্টগ্রাম ব্যুরো থেকে নূরুল মোস্তফা কাজী জানান, গরিবের হক কোরবানির পশুর চামড়া সরকারনির্ধারিত মূল্য তো দূরের কথা শহরে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হলেও গ্রামেগঞ্জে ক্রেতার দেখাই মিলেনি এমনকি বিনামূল্যে দেয়ার জন্যও অনেক ক্ষেত্রে লোক মিলেনি। ফলে শেষ পর্যন্ত অনেককেই মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়েছে। অনেকে আবার এতিমখানাগুলোতে নিজ খরচায় চামড়া লবণজাত করার জন্য পৌঁছে দিয়ে কোনো রকমে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কাঁচা চামড়ার আড়তদার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নামমাত্র মূল্যেই মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কয়েক বছর আগেও একটি কোরবানির গরুর চামড়া প্রায় ৩০০০ টাকা পর্যন্ত দামে কোরবানিতাদাদের কাছ থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কিনে নিতেন, আর সেই টাকা যেত কোরবানির বিধান অনুযায়ী গরিব মানুষের কাছে। এখন সেই চামড়ার ক্রেতাও নেই। গত তিন বছরে বিপুল লোকসানের তিক্ত অভিজ্ঞতায় গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চামড়ার কোনো ক্রেতা ছিল না এবার। আবার শহরে মৌসুমি ক্রেতা থাকলেও দাম মিলছে ৫০-২০০ টাকা। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের নামমাত্র মূল্যে ক্রয়কৃত এসব চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে আড়তদারদের কারসাজিতে মাথায় হাত দিতে হচ্ছে ২০১৯ সাল থেকে। সে বছর চট্টগ্রামে প্রায় সোয়া লাখ চামড়া রাস্তার ওপরেই নষ্ট হয়। এর পরের বছরও বিপুল চামড়া পথে পথে নষ্ট হয়েছে। আর গত বছর অনেকেই চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে ফেলায় এবং অনেকে ক্রেতা না থাকায় নিজ খরচে লবণজাত করার জন্য বিভিন্ন এতিমখানায় পৌঁছে দেয়ার ফলে চামড়া তেমন নষ্ট হবার খবর না এলেও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে। এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে আড়তদারদের দাবি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এবার ভালো দাম পেয়েছেন। আনাড়ি মৌসুমি ব্যবসায়ীরাই বেশি দামে কিনে লোকসানের শিকার হতে পারেন বলে আড়তদারদের দাবি।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, রাজধানির বাইরে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া কেনার কথা ৪০ টাকা থেকে ৪৪ টাকায়। সে হিসাবে একটি গরুর চামড়ার দাম ন্যূনতম সাড়ে ৬শ হতে ১ হাজার টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লবণযুক্ত গরুর চামড়া কেনা হচ্ছে ২ শ’ হতে সাড়ে ৩ শ’ টাকায়। যদিও কোন কোন আড়তদার ৭ শ’ টাকায় একপিস গরুর চামড়া কেনার দাবি করেছেন।
আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দরদামে সময় ক্ষেপণ করা হয় কিংবা কিনতে অনাগ্রহ প্রকাশ করা হয়। এভাবেই আড়তদার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বিপুলসংখ্যক চামড়া অতি কমমূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। একই সাথে চামড়ার অস্বাভাবিক কম মূল্যের কারণে হক বঞ্চিত হয়েছে দেশের বিপুল দরিদ্র মানুষ।
নগরীর চৌমুহনী এলাকা থেকে ৭০টি চামড়া নিয়ে আসেন মৌসুমি ব্যবসায়ী মো: জামাল। তিনি বলেন, আমি বড় সাইজের চামড়া ২৫০ টাকায় কিনেছি। এখন আড়তদাররা প্রতিপিস চামড়া ২শ টাকায় কিনতে চাইছেন। আমি এখন কেনা দামে চামড়া বিক্রি করতে চেয়েও পারছি না।
আবার কেউ কেউ কেনা দামের ওপর ২ টাকা লাভ ধরে চামড়া বিক্রি করে কোন রকমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার কথা জানান। কেউ কেউ আগামীতে আর চামড়া কিনবেন না বলেও সাফ জানিয়ে দেন।
এদিকে সরেজমিন দেখা গেছে, আড়তদাররা লবণজাত চামড়া স্তূপ করে নগরীর মুরাদপুর হতে আতুরার ডিপো পর্যন্ত সড়কের ওপর ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রেখে দিয়েছেন। সড়কে এসব চামড়ার অবস্থান দীর্ঘায়িত হলে এলাকার পরিবেশ বিষিয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
চট্টগ্রাম কাঁচাচামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি আবদুল কাদের নয়া দিগন্তের কাছে দাবি করেছেন আড়তদারা কোনো সিন্ডিকেট করেনি। এবার কোনো চামড়াও নষ্ট হয়নি। তবে চামড়ার গুণগত মান এবং অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে আনাড়ি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা মার খেতে পারেন বলে তিনি জানান। চামড়া ১২ ঘণ্টার মধ্যে প্রক্রিয়াজাত করতে হয় জানিয়ে আড়তদারদের এই নেতা বলেন, অনেকেই যে পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ করেছেন সে পরিমাণ জনবল নিয়োগ না দেয়ায়ও সময়মতো প্রক্রিয়াজাত করতে পারেননি। আবার সরকারনির্ধারিত চামড়ার মূল্য থেকে বর্গফুট প্রতি চট্টগ্রামের ট্যানারিতে বিক্রি করলে ১৫ টাকা এবং ঢাকায় প্রেরণ করলে ১৭-১৮ টাকা ব্যয় বাদ দিয়েই তারা চামড়া কিনেন বলে জানান। কিন্তু সেই খরচের টাকার হিসাব না করেই অনেক আনাড়ি মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কিনে লোকসান গুনেছেন জানিয়ে তিনি দাবি করেন, সার্বিকভাবে এবার ভালোমতোই চামড়া সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াজাত করার কাজ শেষ হয়েছে। চট্টগ্রামে এবার প্রায় ৪ লাখের মতো চামড়া সংগ্রহ করা যাবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত মহানগরী এলাকার ১ লাখ ৫০ হাজার চামড়া আতুরার ডিপোর আড়তগুলোতে এসেছে। বাকি চামড়াও জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এসে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পাঁচ টাকায় ছাগলের চামড়া
যশোর অফিস থেকে এম আইউব জানান, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার বাজার যশোরের রাজারহাট। ঈদের পর গতকাল মঙ্গলবার ছিল প্রথম হাট। এদিন হাট ভালোভাবে জমেনি। তারপরও আট থেকে ১০ হাজার চামড়া আসে হাটে। বিভিন্ন জেলার ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে আনেন। কিন্তু আশানুরূপ দাম পাননি বলে অভিযোগ তাদের। বিশেষ করে ছাগলের চামড়া এক প্রকার বিনামূল্য দিয়ে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরেছেন তারা। একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ৪০ টাকায় চামড়া কিনে মাত্র পাঁচ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। আবার একজন ক্ষুদ্র বিক্রেতা ছাগলের ১০টি চামড়া ফেলে দেন বলে নয়া দিগন্তকে জানান। ওই বিক্রেতার দাম দিলীপ। নড়াইল থেকে চামড়া নিয়ে আসেন তিনি।
সকাল ৮টার পরপরই রাজারহাটে চামড়া আনতে শুরু করেন বিক্রেতারা। ১০ টার মধ্যে সব ব্যবসায়ী চলে আসেন চামড়া নিয়ে। কিন্তু হাটে এসে রীতিমতো হতাশ হন। কারণ এ দিন বাইরের কোনো ক্রেতা আসেননি রাজারহাটে। স্থানীয় ক্রেতারা কিনেছেন সব চামড়া। এ কারণে ভালো দাম পাননি বিক্রেতারা।
এ বছর সরকার লবণযুক্ত গরুর চামড়া ৪০ থেকে ৪৪ এবং ছাগলের চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা প্রতি বর্গফুট দাম নির্ধারণ করেছে। রাজারহাটে ফিতা দিয়ে বর্গফুট মেপে চামড়া কিনতে দেখা যায়নি।
নড়াইল থেকে ১০০ গরুর চামড়া ও ১৩টি খাসির চামড়া নিয়ে হাটে আসেন হীরামন বিশ্বাস। তিনি জানান, সরকারনির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। খাসির ১৩টি চামড়া পাঁচ টাকা হিসেবে ৬৫ টাকা হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে ১৩টি চামড়ায় ৬০ টাকা দিয়েছেন স্থানীয় এক ক্রেতা। দাম কম পাওয়ার কারণ হিসেবে হীরামন বলেন, বাইরের ব্যাপারী না আসলে দাম বাড়ে না। ক্রেতা নেই বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এক প্রকার পানির দামে চামড়া কিনেছেন বলে দাবি তার।
নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা থেকে ৪০০ পিস গরুর চামড়া নিয়ে আসেন নিমাই বিশ্বাস। তিনি জানান, সবচেয়ে ভালোমানের প্রতি পিস চামড়া ১০৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন। তবে, গাভীর চামড়া বিক্রি করেন ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। ৪৫টি গরু ও ৪৫টি ছাগলের চামড়া নিয়ে আসেন যশোরের কেশবপুরের বিশ্বনাথ নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি গরুর ৩৫টি চামড়া ৭০০, ছয়টি ১২০০ ও চারটি ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করেন। বিশ্বনাথ ৪০ টাকা দরে ছাগলের চামড়া কিনে যথাক্রমে আট ও পাঁচ টাকায় বিক্রি করেন বলে জানান। হতাশার সুরে ব্যবসা ছেড়ে দেবেন বলে জানান তিনি।
বৃহত্তর যশোর চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল বলেন, ‘মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া চেনেন না। তারা সময়মতো লবণ দেন না। এ কারণে চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। ফলে, তারা ভালো দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তিনি মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চামড়ার ব্যবসায় না আসার আহ্বান জানান।
চামড়া হাটের ইজারাদার ও ব্যবসায়ী হাসানুজ্জামান হাসু বলেন, ‘প্রথম হাটে ৮-১০ হাজার চামড়া উঠেছে। বাইরের ক্রেতা না থাকায় বিক্রি তেমন ভালো হয়নি। ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ভালো দাম পাচ্ছেন না। আগামী শনিবারের হাট জমবে। ওই দিন বাইরের ব্যাপারীরা আসবেন। একইসাথে ব্যাপক সংখ্যক চামড়া উঠবে।’ তিনি বলেন ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে যশোরের ব্যবসায়ীরা ২০১৮ সাল থেকে ১০ কোটি টাকা পাবেন। বিপুল অঙ্কের টাকা বকেয়া রেখে ট্যানারি মালিকরা আবারো চামড়া কিনে তাদের কাছে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু তাদের কথা কেউ শুনছেন না। এ কারণে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে।
এ দিকে, প্রথম হাট পরিদর্শন করেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: রাশেদুল হক, মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামারের উপপরিচালক বখতিয়ার হোসেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ওয়ালিদ বিন হাবিবসহ বিসিকের কর্মকর্তারা।
সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক সরকারি দলের প্রভাবশালীরা
বগুড়া অফিস থেকে আবুল কালাম আজাদ জানান, দেশের অন্যতম কাঁচা চামড়ার বাজার বগুড়া। গত কয়েক বছর ধরে সিন্ডিকেটের দখলে থাকায় কোরবানি দাতা এবং মওসুমি খুদে চামড়া ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়েছেন। ফলে চামড়ার টাকার হকদার গরিব, দুস্থ অসহায়, মসজিদ, মাদরাসাগুলো বার্ষিক এ আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন সিন্ডিকেটের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেন না। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক।
বগুড়া সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দুপুরের পর থেকে শহরের থানা মোড়, বনানী মাটিডালী রোড, চকসূত্রাপুর, বাদুরতলা, ইয়াকুবিয়া মোড়, সাতমাথাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে চামড়া ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনার জন্য অবস্থান নেন। শহরের ভিতর ও গ্রামাঞ্চল থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা (ফড়িয়া) বিক্রি করতে এসে কমদামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। শহরের থানা মোড়ের নারুলী এলাকা থেকে এক যুবক অটোভ্যান যোগে ৮টি চামড়া বিক্রি করতে যান। গড়ে তার ৮টি গরুর চামড়া জোর করে গড়ে ৬০০ টাকা করে কিনে নেয়া হয়। যুবক বলেন, ৭০০ টাকা করে কেনা চামড়া ৬০০ টাকায় বিক্রি করতে তাকে বাধ্য করা হয়। যেখানেই যাই সিন্ডিকেটের লোকজন নির্দিষ্ট দাম বলে। শহরের চকসূত্রাপুরের চামড়া ব্যবসায়ী হাসান বলেন, অনেক চিন্তা ভাবনা করে চামড়া কিনতে হচ্ছে। তিনি ৩ লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া কিনেছেন এক হাজার টাকায়। আর ২৮ হাজার টাকা মূল্যের খাসির চামড়া কিনেছেন মাত্র ২৫ টাকায়। ৫০০-৬০০ টাকার বেশি গরুর চামড়া কিনছেন না। ২-১টা বেশি দামে কিনলেও ছোট চামড়ার সাথে গড় করছেন।
এদিকে কোরবানিদাতারাও এবার কমদামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে তারা চামড়ার টাকা মসজিদ, মাদরাসা, গরিব দুস্থদের দান করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন। শহরের সুলতানগঞ্জপাড়ার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ৬৭ হাজার টাকায় গরু কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে মাত্র ৭শত টাকায় চামড়া বিক্রি করেছি। অথচ নির্ধারিত দাম অনুযায়ী ওই চামড়ার দাম কমপক্ষে ১৫ শত টাকা হয়। প্রশাসন মনিটরিং করলে বিক্রেতারা সঠিক দাম পেত। সরকার দাম বেঁধে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলে তার সুফল মিলবে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত চামড়ার টাকার হকদাররা। ভবিষ্যতে এদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা ট্যানারি মালিকদের কাছে কোটি কোটি টাকা পাবো। দীর্ঘ দিনেও বকেয়া টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। এ কারণে কোনো ঝুঁকি নিচ্ছি না। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যে যার দায়িত্বে চামড়া কিনবে। তারা বিক্রি করতে না পারলে নিজ দায়িত্বে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করবে। চামড়া ক্রয় কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক বলেন, প্রয়োজনে চামড়া সংরক্ষণ করা হবে।