বৈশ্বিক মহামারী কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ জোর কদমে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই পুনরুদ্ধার ব্যাহত হয়। এতে একদিকে চলতি হিসাবের ঘাটতি বাড়তে থাকে, অন্যদিকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পায় এবং প্রবৃদ্ধির গতি কমে যায়। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শরণাপন্ন হয়েছে সরকার। সংস্থাটির কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে। তবে আইএমএফ মনে করে, সংকট উত্তরণে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি কিছু গুরুতর কাঠামোগত সমস্যা রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে জ্বলানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সংস্থাটির দেওয়া ‘শর্ত’ পূরণ করছে বাংলাদেশ। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে চাপ বাড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর।
বাংলাদেশ এসব তাৎক্ষণিক সমস্যা বেশ ভালোভাবে সামলে নিলেও দীর্ঘমেয়াদি কিছু গুরুতর কাঠামোগত সমস্যা রয়ে গেছে বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়া। সংস্থাটি মনে করছে, সফলভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ নিশ্চিত করতে এবং ২০৩১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে অতীতের সফলতার ওপর ভর করে এগোতে হবে এবং কাঠামোগত সমস্যাগুলো আমলে নিতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের পরামর্শ, বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
জানা গেছে, চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দেশের অর্থনীতি গতিশীল রাখতে আইএমএফের শর্তগুলো বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে, রেকর্ড মূল্য বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের, ভর্তুকি কমানোর নানা ধরনের উপায়ও খুঁজছে সরকার। এ ছাড়া রিজার্ভের গণনাপদ্ধতি আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী করা হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম মাসে মাসে সমন্বয় করার ঘোষণাও দিয়েছে সরকার। পানির দাম বাড়ানোর অপেক্ষায়। সরকারের নেওয়া এসব কর্মসূচিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইএমএফের সফররত উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ। এসব কাজে আইএমএফ খুশি। তবে সংস্থাটি আরও চায়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আয় সন্তোষজনক পর্যায়ে বাড়ুক এবং খেলাপি ঋণ কমুক। কিস্তি দেওয়ার সময় এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপগুলো বিবেচনায় রাখবে আইএমএফ।
তবে এসব পদক্ষেপের কারণে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, জ্বালানি তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়ছে। এটি একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়বে। তবে এগুলো আইএমএফের কারণে করছে তা মনে করছি না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ আইএমএফের ভালো ক্লায়েন্ট। তবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন (তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের) দাম এভাবে না বাড়িয়ে সরকারের অনেক জায়গা আছে সেখানে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, বছরের পর বছর বিমানে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি। সেখানে ভর্তুকি প্রত্যাহারের পরামর্শ দেন তিনি।
জানা গেছে, চলমান অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের চূড়ান্ত ধাপের মূল্যায়ন সফর শেষ হয়েছে। এই সফরে আইএমএফ ঋণ দেওয়ার বিপরীতে আরোপিত সংস্কার শর্তগুলোর হালনাগাদ অগ্রগতি ও আগামীর কর্মপরিকল্পনা মূল্যায়ন করেছে।
যতদূর সবুজ সংকেত মিলেছে, তাতে এরই মধ্যে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন রকম সংস্কার উদ্যোগে সন্তুষ্ট আইএমএফ। এর মানে হচ্ছে, ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। যার প্রতিফলন মিলবে আগামী ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক থেকে। আর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকেই প্রত্যাশিত এই ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করা হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ কোড নম্বরের অনুকূলে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, আইএমএফের ঋণ নেওয়ার বিপরীতে সরকারকে প্রধানত তিন ধরনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আবার বিভিন্ন গুচ্ছ শর্ত আছে। এর মধ্যে আর্থিক খাত ও ব্যাংক খাত এবং রাজস্ব খাতের সংস্কার শর্তগুলো অন্যতম। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বাজেট ঘাটতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা। কর অব্যাহতি থেকে বেরিয়ে আসা, করনীতি, শুল্কনীতির উন্নয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে জোরদার ও পৃথক করার ইস্যু রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের রিজার্ভের হিসাবপদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী সংশোধন করা। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও খেলাপি ঋণসংক্রান্ত নানা ইস্যু রয়েছে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, অবকাঠামোগত মান উন্নয়ন সংক্রান্ত, যেখানে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, নতুন আয়কর আইন কার্যকর করা, শুল্কনীতি ও ভ্যাট আইনসহ জ্বালানির দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পদ্ধতি কার্যকরসহ আরও বেশকিছু সংস্কার। তৃতীয়টি হলো সাধারণ শর্ত, যেখানে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো, ব্যাংকের আমানত এবং ঋণের সুদের হার বাজারদরের ওপর ছেড়ে দেওয়া, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানোর মতো সংস্কারমূলক কিছু পদক্ষেপ।
মধ্যমেয়াদি সংস্কারেই আইএমএফ নজর রাখবে বেশি: এ লক্ষ্যে সরকার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুত ‘টাইমবাউন্ড কর্মপরিকল্পনা’র মধ্যে সিংহভাগ থাকছে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় বাস্তবায়নের শর্ত। যার কিছু অংশ এরই মধ্যে বাস্তবায়নে শুরু হয়েছে। যার অগ্রগতি আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আইএমএফ বলেছে, বাজেটে ঘাটতি যত বড় হয়, বাস্তবায়ন পর্যায়ে সরকারের ওপর সেই চাপ তত প্রবল হয়। আইএমএফ তা ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার শর্ত দিয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্পনায় ব্যয় বৃদ্ধিসহ সুরক্ষা প্রোগ্রামের সুবিধাভোগী শনাক্তকরণের জন্য ডাটাবেস ব্যবহার করা। মূল্যস্ফীতি ও জিডিপির অস্বচ্ছ হিসাবপদ্ধতিতে সংস্কার আনতে বলেছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের মতো সামাজিক ব্যয়ের জন্য সময়সীমার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের শর্ত দিয়েছে।
ব্যাংকিং খাতের সংস্কার শর্তের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতির সংস্কার করতে বলেছে আইএমএফ। এ ছাড়া রিজার্ভ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণদান স্থগিতসহ রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল কমাতে বলেছে। সরকারের মূল লক্ষ্য জটিল ও ব্যতিক্রম কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সার্বিক এই সংস্কার আগামী ২৪ সালের মধ্যেই শেষ করা।
অন্যদিকে আইএমএফের ব্যয় সংকোচনের শর্তে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে বলে মনে করে বহুজাতিক সংস্থা অক্সফাম। সম্প্রতি সংস্থাটি এই কৃচ্ছ্রসাধনের নীতির পরিণতি নিয়ে পুরোদস্তুর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘দ্য অ্যাসল্ট অব অস্টিয়ারিটি’ বা ‘কৃচ্ছ্রসাধনের নীতির অভিঘাত’। তাদের ভাষ্য, বিশ্বব্যাপী এই কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই নীতি গ্রহণে বাধ্য করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ভূমিকা আছে। তাদের কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি (এসএপি) একসময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল।
আর সামষ্টিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে, প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি বা আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর পরামর্শে ঋণ নিলে দেশগুলো একধরনের অসম ক্ষমতা সম্পর্কের খপ্পরে পড়ে। এতে অর্থনীতির হয়তো পুনরুদ্ধার হয়, কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে মানুষ ও জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য আরও বড় ক্ষতির কারণ হয়।