পর্যটকে মুখর সেন্ট মার্টিনের বালিয়াড়ি ও প্রবালদ্বীপের সমুদ্র সৈকত। গত অক্টোবরে পর্যটক মৌসুম শুরু হলেও নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে মোহনায় ‘নব্যতার সঙ্কটের’ অজুহাতে চার মাস পর গত শুক্রবার টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথ চালু হয়েছে। এতে কর্মচাঞ্চল্য এসেছে পর্যটন নির্ভর সব ব্যবসায়। হাসি ফুটেছে সাড়ে ১০ হাজার সেন্ট মার্টিন বাসীর। স্বস্তি ফিরেছে তিন লাখ অসহায় কর্মজীবী মানুষের। পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের জীবন জীবিকা স্বাভাবিক হয়েছে।
স্থানীয় পর্যটন নির্ভর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পর্যটকের আগমনে প্রাণ ফিরেছে দ্বীপের; চাঙা হয়েছে সব পর্যটন ব্যবসা। ফলে দূর হবে আর্থিক অনটন। এদিকে অক্টোবর মাসে প্রথম সপ্তাহ থেকে পর্যটন মৌসুম শুরু হলেও নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে মোহনায় নাব্যতা সঙ্কটের অজুহাতে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌ-রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। অথচ নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে মোহনায় দিয়ে প্রতিনিয়ত মিয়ানমারের মালবাহী জাহাজও চলাচল অব্যাহত ছিল। কেবল বন্ধ থাকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ। এর মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, বে-ওয়ান ও বার আউলিয়া নামের তিনটি জাহাজ চলছিল ঠিকই।
এমন বৈষম্যমূলক আচরণের কথা তুলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয় টুয়াক, জাহাজ মালিক সমিতিসহ ১১টি সংগঠন। ১০ জানুয়ারি শহরের একটি অভিযাত হোটেলের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনও করে তারা। এ বিষয়ে পরদিন ১১ জানুয়ারি ঢাকায় বৈঠক হয়। অনেক দেনদরবার, আবেদন ও বাস্তবতা বিবেচনায় অবশেষে ১২ জানুয়ারি টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ চলাচলের অনুমোদন মিলে। চলছে জাহাজ। খুলেছে পর্যটনের দ্বার। আবারো মুখরিত দ্বীপের বালিয়াড়ি, সাগরতীর। প্রাণচাঞ্চ্যল্য ফিরেছে সেন্টমার্টিনে। স্বাভাবিক হয়ে উঠছে পর্যটন ব্যবসা।
এদিকে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে নয় মাস বন্ধ থাকার পর প্রশাসনিক অনুমতিতে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌ-রুটে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। শুক্র ও শনিবার এই দু’দিনে চারটি জাহাজে চড়ে সেন্ট মার্টিন গেছে ৯১৪ জন যাত্রী।
শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) প্রথম দিন ৬১০ জন যাত্রী নিয়ে সেন্ট মার্টিন ভিড়ে এমভি পারিজাত ও এমভি রাজহংস।
দ্বিতীয় দিন শনিবার কেয়ারী সিন্দাবাদ ১৭৪ এবং আটলান্টিক ক্রুজ ৯৮ জন পর্যটকসহ ১৩০ জন যাত্রী নিয়ে টেকনাফ ঘাট থেকে দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। অতিথিদের স্বাগত জানান জাহাজ কর্তৃপক্ষ। রোববার থেকে আরো দু’টি জাহাজ শহীদ সুকান্ত বাবু ও ভাষা শহীদ সালাম চলাচল করবে বলে জানা গেছে।
দীর্ঘদিন পরে জাহাজ চলাচল করায় দ্বীপবাসীর মাঝে দেখা দিয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে পর্যটন ব্যবসা। দেখছে নতুন আশার আলো।
সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দা হাফেজ উল্লাহ। পেশায় একজন ডাব বিক্রেতা। পর্যটকদের কাছে ডাব বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় সাড়ে নয় মাস সেন্ট মার্টিনে আসেনি কোনো পর্যটক। এতে নানা কষ্টে দিন পার করতে হয়েছে তার। তবে এখন দ্বীপে পর্যটক আগমনে মুখে হাসি ফুটেছে হাফেজ উল্লাহ’র।
দ্বীপের আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসমাঈল। পেশায় একজন ইজিবাইক চালক। দ্বীপে পর্যটক আগমনে তারও কষ্টে দিন পার হয়েছে জানান মোহাম্মদ ইসমাঈল।
তিনি বলেন, পর্যটক না আসলে ইজিবাইক চালিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ থেকে ২০০ টাকা আয় করা যায়। কিন্তু তা দিয়ে তো সংসার চলে না। এখন পর্যটক আসাতে প্রতিদিন এক হাজার টাকার বেশি আয় হচ্ছে। দ্বীপে পর্যটক আসলে আমরা খুব খুশি।
বার্মিজ দোকানি রহিম বলেন, বেচাবিক্রি ছিল না। তাই দোকানও বন্ধ রেখেছিলাম প্রায় সাড়ে নয় মাস। এখন পর্যটক আসছে তাই দোকানও খুলেছি। বেচাবিক্রিও হচ্ছে। সুতরাং কষ্টের দিন শেষ হয়েছে।
শুটকি দোকানি জমির বলেন, দোকানে নতুন নতুন শুটকি মাছ এনেছি। এখন পর্যটক আসছে তাদের কাছে শুটকি বিক্রি করব। এবার ব্যবসা ভালো হবে আশা করছি।
দারুচিনি রেস্তোরা ম্যানেজার শফি বলেন, নানা প্রকার তাজা মাছ রেস্তোরাঁয় রয়েছে। পর্যটকরা যেটা পছন্দ করছে, তাদের সেটায় তাৎক্ষণিক রান্না করে দিচ্ছি। পর্যটকরাও এই মাছ খেয়ে খুব খুশি। আমরা পর্যটকদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করি সবসময়। আশা করি, এই মৌসুমটা বেশ ভালো কাটবে।
জাহাজ মালিকদের সংগঠন সি-ক্রুজ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (স্কোয়াব) এর সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, অনুমতি পাওয়ায় শুক্রবার প্রথম দিন এমভি পারিজাত ও রাজহংস নামের দুটি জাহাজ দমদমিয়া ঘাট থেকে পর্যটক নিয়ে সেন্ট মার্টিন যায়।
শনিবার কেয়ারি সিন্দাবাদ ও আটলান্টিক ক্রুজ চলাচল শুরু করে। অনুমতি পাওয়া অন্যান্য জাহাজগুলো চলাচল করবে।
তিনি বলেন, পর্যটকদের উন্নতমানের সেবা দিতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। এক্ষেত্রে ট্যুর গাইডসহ সংশ্লিষ্টরা যথেষ্ট আন্তরিক।
জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার পর কেমন পরিস্থিতি দেখছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, দু’দিনে চারটি জাহাজ গেল। যারা যাচ্ছে তাদের মধ্যে বেশ আনন্দ-উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা গেছে। তবে, যাত্রী সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কম। প্রচারণা বাড়লে হয়তো আরো বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পরে জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপবাসী সন্তুষ্ট। তাদের মাঝে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে।
প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে হোটেল রিসোর্ট গেস্ট হাউজ ও কটেজ রয়েছে শতাধিক। যেখানে রাত্রিযাপন করতে পারে দুই হাজারের মতো পর্যটক।