একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে খরচ হয় ৮২২ কোটি টাকা। ওই নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএম এবং বাকি ২৯৪ আসনে ভোট হয় ব্যালটে। ছয়টি আসনে সাড়ে চার হাজার ইভিএমের পেছনে খরচ হয় ৯০ কোটি টাকা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হবে। কেননা অর্ধেক আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করতে ইতোমধ্যে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে বাকি ১৫০ আসনের ব্যালটে ভোটগ্রহণসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার খরচ রয়েছে। অর্ধেক আসনে ইভিএম ও অর্ধেক আসনে ব্যালটে ভোটগ্রহণ করলে মোট সম্ভাব্য ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা, যা বিগত সংসদ নির্বাচনের প্রায় ১১ গুণ বেশি।
প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ইভিএম কেনার সিদ্ধান্তকে ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু। গতকাল দুপুরে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার পরও ইভিএম কেনার সিদ্ধান্ত প্রমাণ করেÑ নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়। অবিলম্বে ইভিএম কেনার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
অংশীজনদের মতামত উপেক্ষা করে এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনকে ব্যাপকভাবে আস্থার সংকটের মুখামুখি করছে। এ ছাড়া সরকার যে যৌক্তিক কারণে ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করেছে, সেই নীতির পুরোপুরি পরিপন্থী সিদ্ধান্ত এটি। এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক, কারিগরি ও আর্থিকসহ সম্ভাব্য সব মাপকাঠিতেই বিতর্কিত। তাই কমিশনের ওপর আস্থার সংকট আরও ঘনীভূত করবে।’
ইসি কর্মকর্তারা জানান, নতুন ইভিএম প্রকল্পের খরচ সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত করলে বিগত জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে কয়েকগুণ বেশি খরচ হবে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ইভিএম ছাড়াই কমিশন প্রথমে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দের অনুমোদন দেয়। পরে সেই খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৮২২ কোটি টাকায়। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা এবং নির্বাচন পরিচালনার জন্য বাকি টাকা ব্যয় করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ৪০ হাজার ১৯৯ জন প্রিসাইডিং অফিসার, প্রায় ৮০ হাজার সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং পাঁচ থেকে ছয় লাখ পোলিং অফিসারসহ প্রায় ৭ লাখ নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্মীকে দেশব্যাপী নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত করা হয়। নির্বাচন পরিচালনার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ১৬০ কোটি ৭ লাখ টাকা নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্মীর পেছনে ব্যয় করা হয়। এ ছাড়া দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনে ব্যালট পেপার ছাপানোর জন্য ৩০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। অন্যান্য মুদ্রণসামগ্রী কেনার জন্য ১০ কোটি টাকা, স্ট্যাম্প প্যাড, বিভিন্ন ধরনের সিল ও কালি কেনার জন্য ৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়। সেই নির্বাচনে ৬টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হয়েছিল। ৬ আসনে সাড়ে চার হাজার ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল, যার মূল্য ৯০ কোটি টাকা। যদিও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয়ে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়, যার মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৮২২ কোটির মধ্যে ২৯৪ আসনে ব্যালট পেপার ছাপানো, মুদ্রণসামগ্রী ও সিল-কালির পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। আসন্ন নির্বাচনে দেড়শ আসনে ব্যালটে ভোট করলে গত নির্বাচনের হিসাবে ২৫ কোটি টাকা কমবে। দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করতে লাগবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে ৩০০ আসনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খরচ, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ব্যয় যুক্ত করলে একাদশের তুলনায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের খরচ বাড়বে প্রায় ১১ গুণ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসি যে রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে, তাতে মহানগর ও জেলা সদরের সর্বোচ্চ দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। বর্তমানে দেড় লাখ ইভিএম রয়েছে ইসির কাছে। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন সিইসি কেএম নূরুল হুদার কমিশন প্রায় চার হাজার কোটি টাকায় ইভিএম কেনার প্রকল্প নেয়। দেড় লাখ ইভিএম দিয়ে ৭০ থেকে ৮০টি আসনে ভোট করা গেলেও মাত্র ৬টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। ইভিএম সংক্রান্ত বর্তমান প্রকল্প ২০২৩ সালের জুনে শেষ হচ্ছে। ২০১৮ সালে নেওয়া ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুই লাখ ইভিএম কেনা এবং আগেরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার নতুন প্রকল্প চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন।
জানা গেছে, প্রতিটি নতুন ইভিএমের সম্ভাব্য মূল্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে ২ লাখ ইভিএম মেশিন কিনতে ৫ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। বাকি টাকা ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যয় হবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে ইভিএম ক্রয় করা হয়েছিল। সেই সময় প্রতিটি ইভিএমের দাম পড়ে ২ লাখ টাকা। সেগুলোর মধ্যে বেশকিছু ইভিএম সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট ও চুরি হয়ে যায়।