১৯৫২ সালে বাঙালি তার মায়ের ভাষার অধিকারের জন্য প্রাণ দিয়েছিল। বিশ্ববাসী একুশে ফেব্রুয়ারির সেই আত্মদানকে সম্মান জানিয়ে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। যে দেশে মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে, সেই দেশের প্রধান ভাষা বাংলা ছাড়া অন্য নৃভাষাগুলো সংরক্ষণে জোর দেওয়া হচ্ছে না। বাংলা ভাষাসহ দেশের অভ্যন্তরে মাতৃভাষাগুলোর উন্নয়ন ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। এই প্রতিষ্ঠানেরই এক সমীক্ষায় দেশে স্বীকৃত ৪০টি মাতৃভাষার মধ্যে ১৪টিকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরই মধ্যে সাত বছর পার হয়ে গেছে; কিন্তু আজও বিপন্ন ভাষাগুলো টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা বাস্তবতার মুখ দেখেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাবে এই ভাষাগুলো।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আইএমএলআই) বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র্র নৃগোষ্ঠীর অবস্থান ও ভাষা-পরিস্থিতির তথ্য অনুসন্ধানের জন্য একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। ‘বাংলাদেশের নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’ নামের এ কর্মসূচি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. মো. সাইফুর রশীদ ও হাসান এ শফি এবং ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৌরভ সিকদারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। তিন কোটি ৮৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঠপর্যায়ে সমীক্ষাটি চালানো হয়।
আইএমএলআই পরিচালিত এই সমীক্ষায় ৪০টি ক্ষুদ্র্র নৃগোষ্ঠীর তথ্য-উপাত্ত সংগৃহীত হয়, যাদের নিজস্ব মাতৃভাষা আছে। ওই ভাষাগুলো হলো অহমিয়া, বম, চাক, চাকমা, গারো, হাজং, ককবরক, কানপুরী, খাড়িয়া, খাসি, খিয়াং, খুমি, কোচ, কোডা, কোল, কন্দ, কুরুখ, লিঙ্গম, লুসাই, মাদ্রাজি, মাহলে, মালতো, মণিপুরি মৈতৈ, মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া, মারমা, ম্রো, মু-ারি, নেপালি, ওড়িয়া, পাংখোয়া, লালেং বা পাত্র, রাখাইন, রেংমিৎচা, সাদ্রি, সাঁওতালি, সৌরা, তঞ্চঙ্গ্যা, থর, তেলেগু ও উর্দু। এর মধ্যে ১৪টি ভাষাকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যদিও অন্যান্য সূত্রে বিপন্ন ভাষার সংখ্যা আরও বেশি বলে জানা যায়।
সাত বছর আগে সম্পন্ন হওয়া সমীক্ষাটিতে দেখা গেছে, দেশের বিপন্ন ভাষাগুলো হচ্ছে খাড়িয়া (জনসংখ্যা আনুমানিক এক হাজার), সৌরা (আনুমানিক এক হাজার, তবে এ ভাষায় কথা বলে মাত্র চারজন), কোডা (৬০০ থেকে ৭০০), মু-ারি (৩৮ হাজার ২১২), কোল (আনুমানিক দুই হাজার ৮৪৩), মালতো (আনুমানিক আট হাজার), কন্দ (৬০০ থেকে ৭০০), খুমি (তিন হাজার ৩৬৯), পাংখোয়া (দুই হাজার ২৭৪), রেংমিৎচা (আনুমানিক ৪০), চাক (দুই হাজার ৮৩৫), খিয়াং (তিন হাজার ৮৯৯), লালেং বা পাত্র (দুই হাজার ৩৩) ও লুসাই (৯৫৯ জন)।
তবে বাংলা উইকিপিডিয়ায় বাংলাদেশের বিপন্ন ১৮টি ভাষার একটি তালিকা আছে। সেগুলোর মধ্যে আটটি ভাষাকে নিশ্চিতভাবে বিপন্ন, তিনটিকে নিদারুণভাবে বিপন্ন এবং সাতটি ভাষাকে অরক্ষিত ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই তালিকায় এমন চারটি ভাষার উল্লেখ আছে, যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তৈরি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নেই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৪০টি ভাষার মধ্যে মাত্র আটটির নিজস্ব বর্ণমালা আছে। সেগুলোর মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রি- এই পাঁচ ভাষায় প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই রচনা করেছে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
‘বাংলাদেশের নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’ কর্মসূচির পরিকল্পনা অনুসারে সমীক্ষা প্রতিবেদন ১০ খ- করে বাংলা ও ইংরেজিতে মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করার কথা। কিন্তু গত সাত বছরে বাংলায় মাত্র এক খ- প্রকাশিত হয়েছে। বাকিগুলো এখনো আলোর মুখ দেখেনি। নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা প্রতিবেদন যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিতই হয়নি, সেখানে পরবর্তী পদক্ষেপ তথা বিপন্ন ভাষাগুলোকে রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ তো দূরের কথা।
ভাষাবিজ্ঞানীরা বলেন, নিকট-ভবিষ্যতে লুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এমন ভাষাই হচ্ছে বিপন্ন ভাষা। সাধারণত তিনটি কারণে ভাষা বিলুপ্তির দিকে যায়। সেগুলো হচ্ছে প্রত্যক্ষ গণহত্যা, গোষ্ঠীগত আধিপত্য ও বহিরাগত ভাষা শিক্ষা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের প্রায় ছয় হাজার ভাষার মধ্যে দুই হাজার ৫০০টি বিপন্ন। প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষার মৃত্যু হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো বিপন্ন ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সেই ভাষার প্রামাণ্যকরণ বা ডকুমেন্টেশন জরুরি। একটি ভাষাকে ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন করা গেলে ওই ভাষাটি টিকে থাকবে অনন্তকাল। ভাষা বাঁচিয়ে রাখতে দেশের নৃগোষ্ঠীর প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় নিশ্চিত করতে হবে। যাদের লিখিত বর্ণলিপি নেই; সেসব ভাষার লিপি তৈরি করা প্রয়োজন। ভাষাকে সংরক্ষণ করে জাদুঘরে রাখলে হবে না, সেসব ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে। এখনই ভাষানীতি ও ভাষা পরিকল্পনার দাবি জানান তারা।
এ বিষয়ে সমীক্ষাটির নেতৃত্বদানকারী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও ভাষাবিজ্ঞানী সৌরভ সিকদার আমাদের সময়কে বলেন, যদিও আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০টি কিন্তু তাদের ভাষা পেয়েছি ৩৯টি। কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কমন ভাষায় কথা বলে তাই তাদের আলাদা ভাষা নেই। তাদের কয়েকটি ভাষার অবস্থা ভালো না। কারও কারও নিজস্ব লিপিও নাই। আমাদের গবেষণায় ১৪ বিপন্নপ্রায় ভাষা পেয়েছিলাম। এগুলো যদি রক্ষার জন্য উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তা হলে একসময় হারিয়ে যাবে। তবে সরকার আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছে। পাঁচটি ভাষা বই তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেগুলো পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নাই। ফলে এটা কার্যকর হচ্ছে না।
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং আমাদের সময়কে বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সমীক্ষা পরিচালনার মাধ্যমে একটি বড় কাজ করেছে। কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। তাদের সমীক্ষার তথ্য বলছে, ১৪টি ভাষা বিপন্ন, যেগুলো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর। কিন্তু আমাদের মতে এ সংখ্যা ২৫টি। এমন কিছু ভাষা রয়েছে, যেগুলো কিছু সংখ্যক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছাড়া তরুণ কিংবা ছাত্রছাত্রীরাও বলতে পারবে না। সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মারা যাওয়ার পর সেই ভাষাও হারিয়ে যাবে। আদিবাসী ভাষার রয়েছে গল্প, রয়েছে অনেক ইতিহাস। এসব ভাষা বিলুপ্ত হলে সাংস্কৃতিকভাবে যেমন ক্ষতি হবে, তেমন ক্ষতি হবে প্রাকৃতিকভাবেও। দেশের আদিবাসীদের বিপন্ন ভাষা রক্ষার জন্য বাংলা একাডেমির মতো আদিবাসী ভাষা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানান তিনি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ বলেন, একটি সমীক্ষার মাধ্যমে ভাষার সংখ্যা এবং বিপন্ন ভাষাগুলো বের করা হয়েছে। বিপন্ন ভাষাগুলো সংরক্ষণের জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছি। এই কাজগুলো সময়সাপেক্ষ বিষয়। মাঠ পর্যায়ে এগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে।