রবিবার, ০১:২২ অপরাহ্ন, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা চায় না পুলিশ

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫
  • ৪ বার পঠিত

পুলিশের বাইরে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা চায় না পুলিশ প্রশাসন। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের কাছে পাঠানো মতামতে এ কথা জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। কী কারণে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনে তাদের আপত্তি, তার নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে এতে। তারা বলেছে, স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠিত হলে রাষ্ট্রে পুলিশের কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা উভয়ই হারাবে। সমাজে জনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে। এ ছাড়া ফৌজদারি বিচারকেন্দ্রিক সমন্বিত সুশাসন সম্পর্কিত সমস্যাগুলো আরও জটিল আকার ধারণ করবে। এতে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে অস্থিরতা আরও বাড়াতে পারে বলে পুলিশের মতামতে উল্লেখ করা হয়েছে।

ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের বিষয়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ বিভাগ। তারা ফৌজদারি মামলা তদন্তে পুলিশ বাহিনীর বাইরে স্বতন্ত্র একটি সংস্থা গঠনে নিজেদের ঘোর আপত্তির কথা জানায় বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের কাছে। পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন, তদন্তে পৃথক স্বতন্ত্র সংস্থা গঠিত হলেই যে কোনো ফৌজদারি মামলার তদন্ত স্বচ্ছ, প্রভাবমুক্ত, দ্রুত এবং মানসম্পন্ন হবে- এমন যুক্তির সঙ্গে তারা একমত নন। পুলিশ কর্মকর্তাদের যুক্তি- পৃথক তদন্ত সংস্থা দিয়ে মামলা তদন্ত করা হলে তা আইনশৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা এবং অপরাধ দমন কাজের ক্ষেত্রে বড় ছন্দপতন ঘটাতে পারে। এর ভুক্তভোগী বিচারপ্রার্থীরা হবেন বলেও মনে করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ে দাখিলকৃত তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে ফৌজদারি মামলার তদন্তের জন্য পুলিশের বাইরে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করে। এ বিষয়ে পুলিশ বাহিনীর মতামত জানতে চেয়ে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন গত ২ জানুয়ারি পুলিশের আইজিপিকে একটি চিঠি দেয়। ওই চিঠি পাওয়ার পর আইজিপি বাহারুল আলম পুলিশের সব ইউনিটপ্রধান ছাড়াও পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে বৈঠক করেন। এরপর মতামত তৈরি করে পাঠিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের কাছে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা আমাদের সময়কে বলেন, স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থার দরকার নেই, প্রয়োজন হচ্ছে পুলিশকে রাজনৈতিক নির্বাহীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা। ফৌজদারি মামলা তদন্ত করতে হলে যিনি তদন্তকারী, এটা শুধু তার জুরিডিকশন। এখানে কারও কোনো কিছু বলার নেই। তদন্তের ক্ষেত্রে সাব-ইন্সপেক্টর তদন্ত করলে আইজিপিরও কিছু বলার নেই। (নির্বাহীরা) একটি তদন্তের তত্ত্বাবধান করতে পারে, কিন্তু জবরদস্তি করতে পারবে না। তাই তদন্ত বিভাগটা রাজনৈতিক নির্বাহীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকতে পারলে ভালো। এটা শুধু জুডিশিয়ারির কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, যা এখনও আছে। এখন আইন যেটা আছে, সেটার মাধ্যমে তদন্ত করলে পুলিশ স্বাধীন।

পুলিশের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠন না করে প্রতিটি থানার বিদ্যমান তদন্ত সংশ্লিষ্ট জনবল নিয়ে স্বতন্ত্র তদন্ত শাখা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী বা মানসম্মত করার কথা বলেছে। একই সঙ্গে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সব সংস্থার পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোসহ সবক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সংস্কারের প্রস্তাব করেছে। পুলিশের পেশাগত সক্ষমতা বৃদ্ধি, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও অন্যান্য অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া বিচারিক কার্যক্রম অধিক দক্ষতা ও দ্রুত পরিচালনা করতে একটি স্বতন্ত্র ও জবাবদিহিমূলক প্রসিকিউশন সংস্থা বা অ্যাটর্নি সার্ভিস তৈরির প্রস্তাব করেছে পুলিশ। প্রস্তাবিত প্রসিকিউশন সংস্থায় আইন বিষয়ে ডিগ্রিধারী ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে এবং অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ বিদ্যমান কোর্ট পুলিশে কর্মরত সিএসআই/জিআরওগণ হতে তদূর্ধ্ব পুলিশ কর্মকর্তাদের নিতে প্রস্তাব করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর মনে করে, পুলিশের অধীন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তকাজ সমাপ্ত করতে পারবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের মতামতে বিদ্যমান কোর্ট পুলিশ কর্তৃক প্রসিকিউসন ম্যানেজমেন্টের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বিচারিক আদালতে মামলার ডকেট সংরক্ষণ, মালখানা ও হাজতখানা ব্যবস্থাপনা, আসামিদের নিরাপত্তা, সাক্ষীদের সুরক্ষাসহ সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হবে বলে মনে করে পুলিশ।

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, লজিস্টিক এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা দূরীকরণেরও প্রস্তাব করেছে পুলিশ। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায়ই পুলিশের তদন্তের মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। পুলিশের মতামতে বলা হয়েছে- এ ব্যর্থতা শুধুমাত্র পুলিশের নয়, বাংলাদেশের সব তদন্তকারী সংস্থার অনুরূপ বা ততধিক ব্যর্থতা রয়েছে। এটা রাষ্ট্রের সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক দায়। মূলত রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, লজিস্টিকস এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা, সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি এর মূল অনুঘটক বলে মনে করে পুলিশ।

পুলিশের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, পুলিশের গোয়েন্দা তথ্য ও সমাজিক নেটওয়ার্ক সমাজের তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে পুলিশ বাহিনীতে বিদ্যমান গোয়েন্দা সংস্থা অপরাধ তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করে থাকে। গোয়েন্দাভিত্তিক তদন্ত সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে। এর পাশাপাশি চলমান ফৌজদারি মামলাসমূহ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সমাধানে সাহায্য করে। পক্ষান্তরে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থার পক্ষে নতুন করে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং জনসংযোগ কার্যক্রম তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করা ব্যাপক সময়সাপেক্ষ হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানিক পুনর্বিভাজন সুনিশ্চিতভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রেক্ষাপট তৈরি করবে।

ফৌজদারি অপরাধের কোনো মামলার তদন্ত করার ক্ষেত্রে অপরাধীদের গ্রেপ্তার, মালামাল উদ্ধার, আলামত সংগ্রহ, আসামি হেফাজতে নেওয়া, আদালতে সোপর্দ, রিমান্ড চাওয়া ও পুলিশ রিপোর্ট দাখিল ইত্যাদি নানাবিধ তদন্ত সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ পুলিশের রয়েছে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ প্রায় ২০ হাজার এসআই (নিরস্ত্র) এবং ৫ হাজার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) পদমর্যাদার তদন্ত কর্মকর্তা। এ ছাড়া অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশে রয়েছে সাইবার ফরেনসিক ল্যাব, কেমিক্যাল ল্যাব, আইটি ল্যাব, হস্তলেখা ও হস্তরেখা বিশারদ। বিভিন্ন ল্যাবে সিআইডি নতুন উপায়ে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বলে পুলিশের মতামতে উল্লেখ করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ১৫০ বছর ধরে উপমহাদেশে পুলিশ বিভিন্ন আইন, বিধি বিধানের আলোকে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করে আসছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও সফলতা। নতুন তদন্ত সংস্থা করতে হলে প্রশিক্ষিত জনবল, অবকাঠামো, লজিস্টিকসহ অন্যান্য সহায়তা লাগবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় হবে। এটা না করে পুলিশের সিআইডি, পিবিআইসহ বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। ২০০৯ সালে নিম্ন আদালতের প্রসিকিউসনের কাজ সিএসআইদের থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এতে যেমনি দুর্নীতি বেড়েছে এবং মামলার সাজার হার কমেছে। এ ছাড়া মামলার নথি গায়েবের ঘটনা ঘটে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের পিপির অফিস থেকে গায়েব হওয়া ১ হাজার ৯১১টি মামলার নথির (কেস ডকেট-সিডি) মধ্যে ৯ বস্তা পাওয়া গেছে একটি পুরান কাগজের দোকানে, যেগুলো পুলিশ উদ্ধার করেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com