গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ঢাল হিসেবে কাজ করার পুরস্কারও নিয়েছেন তারা। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাকালীন অনেকে তথ্য গোপন রেখে আবার কেউ কেউ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সরকারি প্লট বাগিয়ে নিয়েছেন। রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারি প্লট ভাগবাটোয়ারায় ছিলেন আমলারাও। বিশ্লেষকদের মতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আবার নিজেদের কলমের খোঁচায় যখন সরকারি প্লট নেন তখন ক্ষমতার প্রভাব খাটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। সরকারি প্লট বাগিয়ে নেওয়া এ রকম অর্ধশতাধিক
কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তাদের কেউ সরকারি প্লট নিয়েছেন নিজের নামে কেউবা স্ত্রীর নামে। অবশ্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্লট বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কোটা পদ্ধতি ছিল। তবে এই কোটা পদ্ধতিও নিজেদের সুবিধার্থেই যুক্ত করেছিলেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গণ-অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবার ও আওয়ামী লীগ আমলে সরকারি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম খতিয়ে দেখতে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আইনজীবী জসিম উদ্দিন সরকার ও প্রকৌশলী আলমগীর হাসিন। এই কমিটি ২০০৯ সাল থেকে যত প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেগুলোতে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে তা খতিয়ে দেখে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেবে। এরপর হাইকোর্ট থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।
সরকারি প্লট বরাদ্দে কোটা পদ্ধতি থেকেই বোঝা যায় আমলারা মূলত এটি চালু করেন নিজেদের সুবিধার্থে। সুবিধা নিতেই যুক্ত করা হয় ১৩ (ক) ধারা। সরকারি প্লট, ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কোটা ১০ শতাংশ। এ ছাড়া সাংবিধানিক পদে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তারা পান ০.৫০ শতাংশ।
সরকারি প্লট বরাদ্দে ১৩ (ক) ধারাটি সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, প্রথমত এ ধারাটি অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক। এটি করা হয়েছিল মূলত ক্ষমতাসীনদের সহযোগীদের সুবিধা দেওয়ার জন্য। উচ্চপর্যায়ের আমলারা যদি ওই ধারা অনুসরণ করে নিয়ে থাকেন তাহলে বলা যায় ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে। যেখানে সংবিধানে বলা হয়েছে সকল নাগরিকের সমান অধিকার, সেখানে কোন যুক্তিতে বা কোন মানদ-ে কোটারিভুক্ত করা হয়েছে তার সঠিক ব্যাখ্যা নেই। এ জন্য এই অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক ধারা বাতিল চাই।
প্লট নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্লট বরাদ্দ নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। যিনি ছিলেন আমলাদের মধ্যে প্রভাবশালী। তিনি পূর্বাচলে একটি প্লট বাগিয়ে নেন। এ ছাড়া প্লট নিয়েছেন মিল্কভিটার সাবেক চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. নবীরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবির, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ও সচিব এ বিএম আমিন উল্লাহ নূরী। প্লট নিয়েছেন সাবেক সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলম, যিনি পরবর্তী সময়ে সরকারের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্লট নেওয়ার তালিকায় রয়েছেন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ, সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রীর একান্ত সচিব এ কে এম সাজ্জাদ হোসেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক পরিচালক নাসিম আনোয়ার, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-২ ওয়াহিদ মুসাররত অনীতা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৩ ডা. মো. জুলফিকার আলী, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ফারজানা ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আমিন আহমেদ, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অফিস সহায়ক নাজমা বেগম, পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মানিক, সাবেক আমলা জিয়াউল হাসান। এর বাইরে অনেক কর্মকর্তা নিজের পেশার নাম উল্লেখ না করেও প্লট নিয়েছেন। এদের প্রায় সবাই রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্লট মালিক।
রাজউকের ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে প্লট নিয়েছেন এমন আমলাদের মধ্যে রয়েছেন- উপসচিব আশুতোষ মন্ডল। অবশ্য তিনি নিজের নামে না নিয়ে স্ত্রী তন্দ্রা সিকদারের নামে প্লট নিয়েছেন। সরকারি আইনজীবী অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোদ্দাসির হোসেন; সরকারি চাকরিজীবী কোটায় প্লট নিয়েছেন মো. মামুন অর রশিদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক অধ্যাপক ড. শেখ আব্দুস সালাম; স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে প্লট নেন মো. জামাল উল্লাহ। সরকারি চাকরিজীবী কোটায় আরও প্লট সারা আরা মাহমুদ, ডা. সেলিম মাহমুদ, সাবেক আমলা দুলাল কৃষ্ণ সাহা, মো. আকতার উজ জামান, প্রকৌশলী হাবিবুল, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সায়ীদুল হক, সামসুদ্দীন আহমদ, মো. লাহুত মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আব্দুর রহমান শেখ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্টাফ মো. ইমরুল চৌধুরী।
রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মো. সিদ্দিকুর রহমান সরকার এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, রাজউক কাউকে প্লট বরাদ্দ দেয় না। মন্ত্রণালয় থেকে যে আদেশ আসে তা বাস্তবায়ন করে। বিগত সময়ে ১৩ (ক) ধারায় যেসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে সুপ্রিমকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটি যে সুপারিশ দেবে তারপর কোর্ট থেকে একটা আদেশ আসবে। কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে রাজউক। আমাদের হাতে শুধু এই ক্ষমতা রয়েছে যদি কেউ মিথ্যা তথ্য দেয় বা তথ্য গোপন করে প্লট নিয়ে থাকেন তাহলে যে কোনো সময় বাতিল করা যাবে। এর বাইরে প্লট বাতিল করার ক্ষমতা রাজউকের নেই।