দেশে প্রথমবারের মতো ‘রিওভাইরাস’ নামে নতুন একটি ভাইরাস পাওয়া গেছে। নিপাহভাইরাসের মতো উপসর্গ আছে, খেজুরের কাঁচা রস খেয়েছে ও এনকেফালাইটিস বা মস্তিষ্কের প্রদাহ রয়েছে এমন রোগীদের পরীক্ষা করে এই ভাইরাস শনাক্ত করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তবে আক্রান্তদের কারও অবস্থায় গুরুতর ছিল না এবং তারা সবাই চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন।
কাদের ঝুঁকি বেশি : আইইডিসিআরের বিজ্ঞানীরা জানান, রিওভাইরাস হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্বাসকষ্ট, জ¦র, মাথাব্যথা, বমি ও ডায়রিয়া। গুরুতর ক্ষেত্রে, এটি নিউমোনিয়া বা এনকেফালাইটিস (মস্তিষ্কের প্রদাহ) সৃষ্টি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশু ও বয়স্করা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে আশ্বস্ত করেন অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আরও বিশ্লেষণ এবং গবেষণা প্রয়োজন। বাংলাদেশে অনেকের মস্তিষ্কের প্রদাহ হয়, কিন্তু কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা যদি এ ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে আরও কিছু ভাইরাল ইনফেকশনে এ ধরনের ভাইরাস শনাক্ত করতে পারি এবং বিশেষ করে মস্তিষ্কে প্রদাহ রোগীদের সংক্রমণের কারণ হিসেবে সুনির্দিষ্ট ভাইরাস শনাক্ত করতে পারি, তা হলে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য হবে।
দেশে যেভাবে শনাক্ত হলো রিওভাইরাস : আইইডিসিআরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. শারমিন সুলতানা বলেন, নিপাহ ভাইরাসের উপসর্গ ছিল, কিন্তু পরীক্ষায় নিপাহ ভাইরাস নেগেটিভ এসেছিল এমন রোগীদের থেকে নমুনা নেওয়া হয়। তারা সবাই খেজুরের রস খেয়েছিল এবং মস্কিস্কে প্রদাহ রোগে আক্রান্ত ছিল। এসব রোগীর মধ্যে অন্য কোনো ভাইরাস সংক্রমণ হলো কি না, সেটা দেখার জন্য অল্পকিছু স্যাম্পল সিকোয়েন্সিং করি। সেখানে দেখা গেল যে কয়েকটি স্যাম্পলের মধ্যে ব্যাট-রিও ভাইরাস, অর্থাৎ যে রিওভাইরাস বাদুড়ে থাকে, সে রকম কিছু ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বাদুড় থেকে অন্য কোনো ভাইরাস খেজুরের রসের মাধ্যমে আসে কি না, সেখানে আমরা দেখলাম যে, কিছু রিওভাইরাস এসেছে।
আইইডিসিআরের বিজ্ঞানীরা জানান, ২০২৩ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে খেজুরের রস খেয়ে যারা মস্তিষ্কে প্রদাহ রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তাদের থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় তাদের শরীরে নিপাহ ভাইরাস পাওয়া যায়নি, কিন্তু নিপাহ ভাইরাসের সব উপসর্গ ছিল।
নিপাহর মতো মারাত্মক নয় : আইইডিসিআরের বিজ্ঞানীরা জানান, এই ভাইরাসটি বেশ পুরনো। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আছে। ১৯৫০ সালের দিকে বিভিন্ন দেশে হয়েছে। এই ভাইরাস বাদুড়ে থাকে। তবে নিপাহ ভাইরাসের মতো অত সিভিয়ার না। রেসপিরেটরি অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো উপসর্গ, যেমন হাঁচি, কাশি, জ্বর, ঠান্ডা হয়।
তবে এই ভাইরাসেরও ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন ডা. শারমিন সুলতানা। তিনি বলেন, ঝুঁকি হলো এটাও বাদুড় থেকে আসে, প্রাণী থেকে মানবদেহে আসছে। শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। আমরা যদি আরও টেস্ট করতে পারতাম, হয়তো আরও ভাইরাস শনাক্ত করা যেত।
আইইডিসিআরের বিজ্ঞানীরা জানান, শীতের সময় নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ে। এ রোগে আক্রান্ত হলে শরীরে প্রচ- ব্যথা, জ¦র, মাথা ঘোরা, বমি ও খিঁচুনি হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি প্রলাপ বকে, অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যায়। শরীরে ভাইরাস প্রবেশের ৭-১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। নিপাহ ভাইরাস বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। বাদুড় কোনো রসের হাঁড়িতে মুখ দিলে সেখানে ছড়ায় ভাইরাস। আর সেই কাঁচা রস পান করলে ভাইরাস পৌঁছায় মানুষের দেহে। নতুন শনাক্ত ভাইরাসটিও একইভাবে ছড়াতে পারে।
৭৫ বছরের পুরনো : এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. শারমিন সুলতানা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাপী ১৯৫০ সালে প্রথম রিওভাইরাস শনাক্ত করা হয়। শীতকালে এর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। বিশ্বে এ পর্যন্ত রিওভাইরাসের নয়টি ধরন শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে চারটি মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। বাংলাদেশে যে ধরনটি শনাক্ত হয়েছে, সেটি ব্যাট-রিওভাইরাস, যা বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। বিশেষ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া দেশগুলোতে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রয়েছে।
সতর্ক হওয়ার পরামর্শ : ডা. শারমিন সুলতানা বলেন, প্রধান সতর্কতা হলো বাদুড় থেকে নিপাহ ও রিওভাইরাস আসছে। সুতরাং আরও অনেক ভাইরাস আসার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং বাদুড় থেকে সংক্রমিত হয় এমন ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা হতে হবে। যেমন আধা খাওয়া ফল খাওয়া, বাদুড়ে খাওয়া রস খাওয়া এসব থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে হবে, যাতে প্রাণী থেকে কোনো ভাইরাস মানবদেহে না আসে। কারণ প্রাণী থেকে মানবদেহে রোগ আসা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এসব রোগ মানবদেহ থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হয়। এসব রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এই রিওভাইরাস হয়তো রেসপিরেটরি বা শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ তৈরি করে, কিন্তু এমন ভাইরাসও তো আসতে পারে, সেটা আরও মারাত্মক হতে পারে। এটা খুঁজে বের করার জন্য আমাদের এই টেস্ট।