অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে দেশের বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ, সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) সরকারি বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত শুরু করেছে। তদন্ত পর্যায়ে আদালতের আদেশের মাধ্যমে অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দ করা হচ্ছে। এ তালিকায় বৃহৎ শিল্প গ্রুপ বেক্সিমকো, এস আলমসহ সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। জব্দকৃত সম্পত্তি দেখভাল ও পরিচালনার জন্য রিসিভার বা তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এরপরও ওইসব সম্পদ এবং তার ওপর নির্ভরশীল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের ভাগ্য অনিশ্চিতই থেকে যায়। এর কারণ, রিসিভার হিসেবে দায়িত্ব ব্যক্তি বা দপ্তর দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হয় না। আবার অনেক সময় পরিচালন ব্যবস্থাও ভালো হয় না। জব্দ হওয়া সম্পদের পরিচালন ব্যবস্থা ঠিক না হওয়ায় একদিকে অনেক প্রতিষ্ঠানের আয় কমে, আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধের উপক্রম হয়ে। অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী ও দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জব্দ করা সম্পদ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পারলে সেখান থেকে আয় কম হয়, আবার কিছু সম্পদ বেহাতও হয়ে যায়। এতে করে ওইসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা পড়েন চরম বিপাকে।
দেউলিয়া বিষয়ক আইনের (১৯৯৭) ৬৪(১) ধারামতে, রিসিভার হলেন একজন স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তি, যাকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বা ব্যবসার কার্যক্রমের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয় আদালত।
দুদকের তথ্যমতে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, মন্ত্রী ও এমপিসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান তদন্ত চলমান রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সিআইডিসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করছে। তদন্ত পর্যায়ে বেক্সিমকো গ্রুপের সম্পদ, এস আলম গ্রুপের ১২৫টি ব্যাংক হিসাব, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সব সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। আরও কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দ করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে। এসব সম্পদ জব্দের পর সেগুলো পরিচালনায় রিসিভার নিয়োগ দেওয়া হবে।
দুদকের কর্মকর্তারা বলেছেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তি আদালতের আদেশে জব্দ করে দুদক। পরে সেই সম্পত্তি দেখভাল ও পরিচালনার জন্য রিসিভার নিয়োগ করে আদালত।
সাধারণত আদালতের আদেশের পর জেলা প্রশাসন থেকে কোনো ব্যক্তি বা অধিদপ্তরকে রিসিভার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানকে রিসিভার নিয়োগ করা হয়ে থাকে। কিন্তু রিসিভারের অধীনে যাওয়া সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়ায় আয় কমে যায়। একপর্যায়ে জব্দকৃত সম্পদ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ বেহাতও হয়।
ধুঁকছে বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান : চলতি বছর ১৯ সেপ্টেম্বর বেক্সিমকো গ্রুপ অব কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনা এবং এর সব সম্পদ জব্দের জন্য রিসিভার নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে গ্রুপটির মালিক সালমান এফ রহমানের বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দেয় আদালত। এ আদেশ বাস্তবায়নের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চার সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
এরপরই গত ১০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সভায় বেক্সিমকো গ্রুপের সব সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রিসিভার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. রুহুল আমিনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সহকারী রিসিভার হিসেবে নিয়োগ দেওয় হয় অতিরিক্ত পরিচালক ড. সুমন্ত সাহা (সিএফএ), যুগ্ম পরিচালক মো. নাহিম উদ্দিন (সিএফএ) এবং উপপরিচালক মো. আতিউর রহমানকে।
এস আলমের ব্যাংক হিসাব জব্দ : দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম ও তার পরিবারের নামে থাকা ১২৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দিয়েছে আদালত। এসব ব্যাংক হিসাবে ২২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা রয়েছে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক ইব্রাহিম মিয়া এ আদেশ দেন।
এর আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত, ব্যাংক হিসাবসহ সব সম্পত্তি জব্দ এবং দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আইনি নোটিস পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. রুকুনুজ্জামান। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার, বিএফআইইউ, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক, পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), পুলিশ সুপার ইমিগ্রেশন বিভাগে এ নোটিস পাঠানো হয়।
সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ : চলতি বছর ২৩ মে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা জমি জব্দ এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে তাদের নামে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। এরপর ২৬ মে বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা সম্পদ জব্দের আদেশ দেয় আদালত। ঢাকা মহানগর আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন। পরে এসব জব্দ করা সম্পদ পরিচালনার জন্য গোপালগঞ্জ জেলা কৃষি অফিসার ও জেলা মৎস্য অফিসারকে রিসিভার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। আর রিসিভারের কার্যক্রম তদারকি করে দুদক ও পুলিশ।
রিসিভার নিয়োগে ও এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুদকের প্রথম কাজ হলো দুর্নীতি দমন করা। এরপর দুর্নীতি করে যারা সম্পত্তি অর্জন করেছে তাদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি ব্যবস্থা নেওয়া। তবে যারা কাজটা করবে তারাই অর্থাৎ যারা রক্ষা করবে তারাই যদি ভক্ষক হয়ে যায় তখন তো আর কোনো কিছু করার থাকে না।’ তিনি বলেন, ‘আদালতের মাধ্যমে কোনো একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দ করে রিসিভারের কাছে দেওয়া হয়। দুর্নীতির অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত রিসিভার জব্দ করা সম্পদের দেখভাল করে থাকেন। এটি অন্তর্বর্তীকালীনের জন্য, এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে, দুদক তার কাজ ঠিকমতো করছে কি না। আমরা বিভিন্ন সময় দুদকের ভেতরের দুর্নীতির যে গল্প শুনেছি সেই প্রতিষ্ঠান সম্পদ জব্দ করলে তার সদ্ব্যবহার হবে সে আশা করা একেবারেই অমূলক। এ কাজে দুদকের আন্তরিকতার অভাব আছে।’
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মীর আহমেদ আলী সালাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জব্দকৃত সম্পদের বিষয়ে দুদকের ফলোআপ থাকা উচিত। যাকে রিসিভার নিয়োগ করা হয় তার দায়িত্ব হচ্ছে তত্ত্বাবধান করা। কেউ তত্ত্বাবধান করতে না পারে তাহলে সেই বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে আদালত ব্যবস্থা নেয়। আবার রিসিভার হিসেবে যিনি নিয়োগ পান, তিনি যদি কোনো সমস্যা বা চাপ মনে করেন তাহলে তিনি অভিযোগ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আদালত ব্যবস্থা নেবে।’
দুদক কর্মকর্তারা বলেন, দুর্নীতিবাজদের সম্পত্তি জব্দ না করলে তারা সেই সম্পদের আয় দিয়ে দুর্নীতি থেকে বাঁচতে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। তাদের আর্থিকভাবে দুর্বল করতে সম্পত্তি জব্দ করা হয়ে থাকে। এসব সম্পত্তি সঠিকভাবে পরিচালনা করলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় হবে। কিন্তু কেউ এটি করতে চায় না। তারা উদাহরণ টেনে বলেন, দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তকালে ডেসটিনি গ্রুপের বিপুল পরিমাণ সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল। জব্দকৃত সম্পদের মধ্যে ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হল কমপ্লেক্স ভাড়া দিয়ে যে আয় হচ্ছে, তা জমা হচ্ছে। কিন্তু ডেসটিনির যে ৮২টি গাড়ি জব্দ হয়েছিল সেগুলোর অস্তিত্ব কি আজও আছে? এসব গাড়ির কী অবস্থা কেউই জানেন না। এ ছাড়া হলমার্ক গ্রুপের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল। শুধু পরিচালনার অভাবে সেই সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও যুবকের সম্পদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। শুধু সম্পদ জব্দ করলেই হবে না, এগুলো পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী ইউনিট থাকতে হবে। তাহলে জব্দকৃত সম্পত্তি পরিচালনার মাধ্যমে আয়ও হবে, সম্পদও ঠিক থাকবে। আর তা না হলে আয় হবে না, সম্পদও বেহাত হবে।
দুদক অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডুসা) একজন সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তি জব্দ করা হয়। পরে জব্দকৃত সম্পত্তি পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসক, সিটি করপোরেশন বা পুলিশকে রিসিভার নিয়োগ করা হয়। জেলা প্রশাসক জব্দকৃত সম্পত্তি দেখভালে করতে ভূমি অফিস বা অন্য কোনো অফিসকে দায়িত্ব দেন। যে অফিসকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা এ বিষয়ে খেয়াল রাখে না, ঠিকমতো সম্পদের ইনভেন্টরি করে না। শুধু ফ্ল্যাট, বাড়ি বা অফিস হলে সেগুলো ভাড়া দিয়ে যা আয় হয় তাই তহবিলে জমা হয়। অন্যান্য সম্পদ বিশেষ করে কলকারখানা, গার্মেন্ট ও যানবাহনসহ অনেক সম্পদ শুধু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। তিনি বেক্সিমকো শিল্প পার্কের উদাহরণ দিয়ে বলেন, গাজীপুরে বেক্সিমকো শিল্প গ্রুপের বৃহৎ কারখানা রয়েছে। এটি জব্দ করে ব্যাংকের মাধ্যমে পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান ঠিকভাবে না চলায় শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনভাতা দেওয়া যাচ্ছে না। যেকোনো সময় এটি বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে।
তিনি বলেন, যেসব সম্পদ জব্দ করা হয় সেগুলো পরিচালনার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দেওয়া দরকার। যদি কোনো কারখানা জব্দ করা হয় সেটি পরিচালনা করতে আরেকজন কারখানা মালিককে দায়িত্ব দেওয়া হয় যাতে তিনি সেটি ঠিকভাবে চালাতে পারবেন। গার্মেন্ট হলে গার্মেন্ট মালিক চালাবেন। অন্য প্রতিষ্ঠান অন্য কোনো মালিক প্রতিষ্ঠানগুলো চালাবেন। তাহলে প্রতিষ্ঠান চলমান থাকবে। অন্যথায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। এতে যন্ত্রপাতিসহ সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে। এতে রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট হবে। দুদকের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, দুদক এখন পর্যন্ত প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ জব্দ করেছে। এটি দলিল মূল্যের হিসাব। প্রকৃত মূল্য ধরলে তা কয়েক বিলিয়ন ডলার হবে। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত চলাকালে যেসব সম্পদ জব্দ করে এবং সেগুলো দেখভালে তেমন কোনো নজর ছিল না। ২০১৯ সালে দুদক একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট চালু করেছে। এই ইউনিট জব্দকৃত সম্পদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ করছে। তালিকা প্রস্তুতের পর জানা যাবে কী পরিমাণ সম্পদ জব্দ আছে, কে কোন প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধান করছে।