একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ঠিক ওই বছরের শুরুতেই দুর্নীতির একটি মামলায় কারগারে পাঠানো হয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপির প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে। প্রথম দিকে বিএনপির নেতৃত্বের ধারণা ছিল শিগগিরই জামিনে বেড়িয়ে আসবেন তিনি। কিন্তু তা আর হয়নি বরং বেগম জিয়ার শূন্যতা বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে অপ্রস্তুত করে দিয়েছিল। পাল্টে দিয়েছিল নির্বাচনপূর্ব আন্দোলনের গতিপথও। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে তারেক রহমান এলেও একাদশ নির্বাচনের আগে আন্দোলনের স্টিয়ারিং ছিল ভিন্ন ভিন্ন হাতে । ড. কামালকে সামনে এনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। ফলাফল দাঁড়ায় সাতটি আসনে। টানা তৃতীয় মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এবারো নির্বাচনী বছরে পা রেখেছে রাজনীতি। বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে সরকারবিরোধী দলগুলোকে সাথে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছে। ঠিক এমন সময়েই বারবার আলোচনায় আসছেন শর্তযুক্ত মুক্তিতে থাকা বেগম খালেদা জিয়া। রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচনমুখী রাজনীতিতে বেগম জিয়াকে ঘিরে কি তাহলে ফের কোনো তৎপরতা চলছে?
২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে ছয় মাসের জন্য শর্তযুক্ত মুক্তি পান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, যিনি কারাগারে থাকা অবস্থায়ই শারীরিক নানা জটিলতায় ছিলেন মারাত্মক অসুস্থ । মুক্তির ক্ষেত্রে শর্ত ছিল তিনি চিকিৎসা নেবেন বাসায় থেকে এবং দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। ঠিক এই দুটো শর্ত মেনেই কয়েক দফায় মুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর মধ্য দিয়ে গত তিন বছর ধরে গুলশানের বাসায় রয়েছেন খালেদা জিয়া। এই তিন বছরে তিনি কমপক্ষে ছয়বার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসা নেন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে। বিএনপির তরফ থেকে বারবার তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আবেদন জানানো হলে তা সরকার কর্ণপাত করেনি।
৭৭ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বহু বছর ধরে আথ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার, হৃদপিণ্ডের জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ হাসপাতালে তার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়। তার বর্তমান শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। একই সাথে তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানোর পরামর্শও তারা দিয়েছেন।
আন্দোলনের মাঠে একসময়কার সরব নেত্রীর এরকম একটি অবস্থায় মাসখানেক ধরে তাকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে। তার রাজনীতি করতে পারা না পারার বিষয়টি নিয়ে যেমন কথা হচ্ছে, তেমনি তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হতে পারে এমন কথাও ভেসে আসছে।
গত ২৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম জাতীয় সংসদে বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না, এমন মুচলেকা দেয়ায় তাকে বাসায় নেয়া হয়েছে।
শেখ সেলিমের এই বক্তব্যকে তখনই ‘অপপ্রচার, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে নাকচ করে দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তবে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্পূর্ণ নতুন কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই, তবে নির্বাচন করতে পারবেন না।’ পরদিন ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপির নেতা হিসেবে খালেদা জিয়া যদি রাজনীতি করতে চান, সে ক্ষেত্রে যে শর্তে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে, সেটি মেনে তাকে করতে হবে।’ এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই।’ অবশ্য ২৩ ফেব্রুয়ারি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, খালেদা জিয়ার বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে কারাগারের বাইরে ঘরে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেই শর্ত অনুযায়ী তিনি রাজনীতি করতে পারেন না। খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে রাজনীতি নিয়ে শর্ত ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে শর্তে তাকে ঘরে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে সেই শর্তে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন এমন কথা নেই।
খালেদা জিয়ার রাজনীতি ও নির্বাচন করতে পারা না পারা নিয়ে মন্ত্রীদের সাম্প্রতিক এমন আলোচনায় ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এখানে সরকারের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরানোর জন্য এটি একটি কূটকৌশল। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ও মানবাধিকার নিয়ে বিদেশীদের অব্যাহত চাপ থেকে বের হয়ে আসতে ক্ষমতাসীনরা সুকৌশলে বেগম জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছেন বলেও বিএনপি মনে করছে। একইসাথে এটি বিএনপির নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত একটি প্রচেষ্টা হিসেবে তারা দেখছে।
বিএনপির অভিমত, বেগম জিয়া অসুস্থ। এই মুহূর্তে তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। নিঃশর্ত মুক্তির দাবিও তাদের।
বেগম জিয়ার রাজনীতি করতে পারা না পারার ইস্যুর মধ্যেই তাকে বিদেশে পাঠানো হতে পারে এমন আলোচনা এখন সামনে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক করেন, তখন এই আলোচনা ডালপালা মেলে। যদিও আইনমন্ত্রী এই ধরনের আলোচনাকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ ষষ্ঠবারের মতো বাড়ানোর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাছে গত ৬ মার্চ আবেদন করেন তার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার। যথারীতি আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় মতামত দেয়ার পর আবেদনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। খালেদা জিয়ার পরিবার এবারো শর্ত শিথিল করে তাকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে আবেদন করেছে সরকারের কাছে। আগামী ২৪ মার্চের আগেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে, নির্বাচনের আগে বেগম জিয়ার বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্তেও যেতে পারে সরকার। হয় তাকে আদালতের মাধ্যমে জামিনে মুক্তি দিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হতে পারে অথবা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশেও পাঠানো হতে পারে। তবে এসব করা হতে পারে দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার অংশ হিসেবে।