বাংলাদেশে চলতি বছরের হজ যাত্রীদের জন্য সৌদি আরবে আসা যাওয়ার বিমান টিকেটের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে হজের খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে হজের জন্য আগ্রহীদের নিবন্ধনই কম দেখা যাচ্ছে।
হজ্জ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ বা আটাব বলছে, বিমান ভাড়া এতো বেশি করে ঠিক করা হয়েছে যে এটি তাদের মতে ‘অবিচার’।
এর ফলে কয়েক দফায় নিবন্ধনের সময় বাড়িয়েও খুব একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অস্বাভাবিক বিমান ভাড়ার কারণে হজ প্যাকেজের দাম বেড়ে যাওয়ায় এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন ওই দু’টি সংগঠনের নেতারা।
অবশ্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বলছে, সার্বিক পরিস্থিতি ও খরচ বিবেচনা করেই বিমান ভাড়া ঠিক করা হয়েছে, যেন বিমানের লাভ না হয়, অন্তত লোকসান যেন এড়ানো সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, এবারের হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ৯৯৭ টাকা। বাংলাদেশের হজ যাত্রীদের বহনের কাজটি করে মূলত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সৌদিয়া এয়ারলাইন্স।
হজ যাত্রীদের জিম্মি করে এ দু’টি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসার সুযোগ করে দেয়ার জন্য ভাড়া আকাশচুম্বী করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এভিয়েশনবিষয়ক বিশ্লেষক।
এখন এ মূহুর্তে সৌদি আরবে আসা-যাওয়ার খরচ এয়ারলাইন্স ভেদে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা বলে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলছে।
বছরের অন্য সময় ওমরাহ পালন বা অন্য কোনো কারণে সৌদি আরবে ৭০-৮০ হাজার টাকার মধ্যেই রিটার্ন টিকেট পাওয়া যায়।
যদিও মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রীদের ভিড় বাড়লে অনেক সময় কিছু এয়ারলাইন্স ওই সুযোগে দাম হুট করে অনেক বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগও আছে।
সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিযোগ যে বছরের অন্য সময়ের লোকসান কাটাতে হজ মৌসুমকে ব্যবহার করছে বিমান।
ভাড়া আসলে কতটা বেড়েছে
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল আজিম বিবিসিকে জানিয়েছেন, চলতি বছরের জন্য ভাড়া প্রথমে তারা দু’লাখ ১০ হাজার টাকা প্রস্তাব করলেও পরে হজ যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে সেটি কমিয়ে এক লাখ ৯৮ হাজার টাকা করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালে এই ভাড়া ছিল এক লাখ ১৮ হাজার টাকা, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ছিল এক লাখ ২৮ হাজার টাকা করে, ২০২০ সালে ছিল এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা, ২০২২ সালে ছিল এক লাখ ৪০ হাজার টাকা।
করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে কেউ হজে যাননি।
আর চলতি বছরের জন্য ভাড়া ঠিক হয়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ৯৯৭ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এ বছর বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব বলেছেন, সাধারণত বিভিন্ন খরচের কারণে নিয়মিত ভাড়ার চেয়ে হজ যাত্রীদের ক্ষেত্রে ভাড়া ৫০/৬০ ভাগ যোগ করে নির্ধারণ করা হয়।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু এ বছর অনেক বেশি ভাড়া ঠিক করা হয়েছে। ভাড়া এতটা বৃদ্ধির সাথে আমরা একমত নই।’
সাধারণত বিমান হজ যাত্রীদের ভাড়াসম্পর্কিত একটি প্রস্তাব এ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটিতে উত্থাপন করে। পরে কমিটি সেটি পর্যালোচনা করে একটি ভাড়ার পরিমাণ চূড়ান্ত করে থাকে।
এ বছর শুরুতে বিমানের পক্ষ থেকে দু’লাখ ১০ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে জাতীয় কমিটি সেটি কিছুটা কমিয়ে এক লাখ ৯৮ হাজার টাকা ঠিক করেছে।
এ বছর ২৭ জুন হজ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন চলতি বছর হজ করতে যেতে পারবেন।
এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার আর এক লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করতে যাবেন।
হজের সময় ভাড়া বাড়তি হয় কেন
হজ মৌসুমকে একটি ‘পিক টাইম’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় বিমানের জন্য। এছাড়া চলতি বছর আটটি বোয়িং শুধুমাত্র হজ যাত্রীদের আনা নেয়ার কাজ করবে।
ফলে বেশ কিছু রুটে বিমান চলাচল কমবে বা বন্ধ হতে পারে। এছাড়া জেট ফুয়েল ও ডলারের দাম বৃদ্ধিও বিমান ভাড়া বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল আজিম বলছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্যাক্স অনেকে বেড়ে যাওয়াতেও বিমানের খরচ বেড়েছে। এছাড়া আশকোনা হাজী ক্যাম্পেও বিমানের অনেক খরচ আছে।
তিনি বলেন, ‘এসব মিলিয়ে এবার যে খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা একেবারেই মিনিমাম বলেই আমরা মনে করি। আমরা লাভের উদ্দেশ্যে কিছু করিনি। বরং যেটা সর্বনিম্ন ধরলে লোকসান এড়ানো যাবে, সেটাই ধরা হয়েছে।’
তার মতে, হজে মোট ১৬টি ক্যাটাগরিতে ব্যয় নির্ধারণ করে হজ প্যাকেজ চূড়ান্ত হয়। এবার সব ক্যাটাগরিতেই ব্যয় বৃদ্ধির কারণে হজ প্যাকেজের দাম অনেক বেড়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘বিমান জাতীয় সংস্থা। হজ যাত্রীদের প্রতি আমাদের দায়িত্বও আছে। কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতি সবার জানা। তারপরও আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, যেন ভাড়া যৌক্তিক নির্ধারণ করা যায়।’
তবে বিমান কর্তৃপক্ষের এ বক্তব্যের সাথে একমত নয় হজ্জ এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সংগঠনটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ইয়াকুব শরাফতী বলছেন, একটি টেকনিক্যাল কমিটি দিয়ে সব পর্যালোচনা করে ভাড়া ঠিক করা উচিত।
এটা করা হলে ক্ষোভ বা অসন্তোষ থাকবে না বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘যে ভাড়া ঠিক করা হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। গত বছরের চেয়ে ৫৮ হাজার টাকা বাড়ানোটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।’
অন্যদিকে এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব বলছেন, যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা যাত্রীদের জন্য অবিচার হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিবছর যেভাবে বাড়ে, তার তুলনায় এবার অনেক বেশি বাড়ানো হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।’
এভিয়েশন বিশ্লেষক যা বলছেন
এভিয়েশনবিষয়ক বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলছেন, হজের সময় যাত্রী বহন করা বিমান আর সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের জন্য মনোপলি ব্যবসা। অন্য কোনো এয়ারলাইন্সকে হজ যাত্রী পরিবহনের সুযোগ দেয়া হয় না।
তিনি বলেন, ‘এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিমান নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে। সৌদিয়াকেও ব্যবসার সুযোগ করে দেয়। কারণ, বিমানের ভাড়াই সৌদিয়ার জন্য প্রযোজ্য হবে। জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েই এটা করা হয়, যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’
ডলারের বিনিময় হার ও জেট ফুয়েলের দামের বিষয়ে তিনি বলেন, সেটি তো এখনো অনেক বাড়তি, তাহলে এখন যে দামে টিকেট দেয়া যাচ্ছে, সে দাম হাজীদের জন্য প্রযোজ্য হবে না কেন।
তিনি আরো বলেন, ‘ডলার ও জেট ফুয়েলের দাম তো আগেই বেড়েছে। এখন গড় ভাড়া ৭০/৮০ হাজার টাকা। হজের ব্যবস্থাপনার জন্য এটা দ্বিগুণ করলেও ভাড়া এক লাখ ২০/৩০ হাজারের বেশি নির্ধারণের সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, এখন বিমানের সব সিট পূর্ণ হয় না। অথচ হজের সময় সব সিট ভর্তি করেই যাত্রী যাবে। সে যুক্তিতেও ভাড়া তখন কম হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘হজ বিমান ও সৌদিয়ার জন্য একটি গ্যারান্টেড ব্যবসা। হজ যাত্রীদের জিম্মি করে এ সুযোগ নিচ্ছে সংস্থা দু’টি। বিমান তার সারা বছরের লোকসান পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ হিসেবেও ব্যবহার করে।’
তবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলছেন হজ যাত্রীদের বিষয়টি ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা বিবেচনা করেননি।
সূত্র : বিবিসি