চুক্তি অনুসারে চাল ও গম আমদানি এখন পর্যন্ত অপর্যাপ্ত। মোট চুক্তির ৭৪ শতাংশ খাদ্যশস্য এখনো দেশে আসেনি। অপরদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পূর্ভাবাস-গত বছরের তুলনায় এবার ২৫ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হবে। কমবে গম ও ভুট্টার উৎপাদন।
এছাড়া কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ কম হয়েছে প্রায় পৌনে ৪ লাখ টন। খাদ্য নিয়ে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মূলত মার্কিন মুদ্রা ডলার ও জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার খবর, আগামী বছরে বিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। যা দুর্ভিক্ষে রূপ নিতে পারে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আসছে বছরে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করেছেন।
এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠকে নিরাপদ মজুতের পরিমাণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখানে স্বাভাবিক খাদ্য নিরাপত্তা মজুতের পরিমাণ ১৩ লাখ টন এবং সংকটকালীন মজুতের পরিমাণ ১৪ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়। বর্তমান খাদ্য নিরাপত্তা মজুতের পরিমাণ সাড়ে ১০ লাখ টন।
জানতে চাইলে খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি বিশ্বখাদ্য বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এতে আমাদের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। আমদানি করতে অতিরিক্ত অর্থের বিষয়টি দেখবে অর্থ মন্ত্রণালয়। আমরা পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী খাদ্যশস্য আসছে। রাশিয়া থেকে এরই মধ্যে ৫০ হাজার টন গম আনা হয়েছে। অন্যান্য দেশ থেকে খাদ্য আমদানি হচ্ছে। মজুত নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা : চলতি বছরের শুরুতে হাওড়ে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আর আমন মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় ধানের উৎপাদন কমতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। সব মিলে এ বছর গত বছরের তুলনায় হেক্টরপ্রতি ফলন ১৩ দশমিক ১ শতাংশ কমবে যা ২৫ লাখ টনের মতো।
এছাড়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে গম ও ভুট্টার উৎপাদন গত বছরের তুলনায় কম হবে। এ বছর ৪ কোটি ৮৪ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২৩ লাখ টন বেশি।
আমদানি পর্যাপ্ত নয় : বিদেশ থেকে আমদানির জন্য এ পর্যন্ত ১১ লাখ ৮০ হাজার টন খাদ্যশস্য আমদানির চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫ লাখ ৩০ হাজার টন চাল এবং গম ৬ লাখ ৫০ হাজার টন।
থাইল্যান্ড থেকে ২ লাখ টন, ভিয়েতনাম থেকে ৩০ হাজার টন, মিয়ানমার থেকে ২ লাখ টন ও ভারত থেকে ১ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে। কিন্তু গত ২৫ আগস্ট পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ টন।
একইভাবে রাশিয়া থেকে জিটুজি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতিতে গম ৫ লাখ টন, ইউক্রেন ও বুলগেরিয়া থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টন আনার চুক্তি হয়।
গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত গম আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার টন। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে ৫০ হাজার টন এবং বুলগেরিয়া থেকে ১ লাখ ২ হাজার টন। অপরদিকে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার টন এবং গম ৩ লাখ ৫৬ হাজার টন।
লাগামহীন বাড়ছে খাদ্যশস্যের মূল্য : এদিকে বাজারে নিয়ন্ত্রণহীন মূল্য পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশ ও বিশ্ব উভয় বাজারেই পণ্যের দাম বাড়ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ তিন বছরে বিশ্বাবাজরে চালের রপ্তানি মূল্য টনপ্রতি থাইল্যান্ডে ৩ হাজার ২৪৮ টাকা (২৯ মার্কিন ডলার), ভারতে বেড়েছে ১ হাজার ১২০ টাকা (১০ ডলার)। অপরদিকে ইউক্রেনে গমের রপ্তানি মূল্য টনপ্রতি বেড়েছে ১৩ হাজার ৪৪০ টাকা (১২০ মার্কিন ডলার)। একইভাবে রাশিয়ায় গমের মূল্য বেড়েছে ১৪ হাজার ৬৭২ টাকা (১৩১ মার্কিন ডলার)। এক্ষেত্রে প্রতি মার্কিন ডলার ধরা হয়েছে ১১২ টাকা।
বিশ্ববাজারে মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারের ওপর। মোটা চাল কেজিতে খুচরা পর্যায়ে ১৮ দশমিক ৩৩ টাকা এবং পাইকারি ১৭ দশমিক ৭১ টাকা বেড়েছে। একই সময়ে আটার খুচরা মূল্য কেজিতে ২২ দশমিক ৭০ টাকা এবং পাইকারিতে ২১ দশমিক ৫৬ টাকা বৃদ্ধি পায়। এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। যা নিম্ন ও মধ্যম শ্রেণির ভোক্তাকে চরম বিপাকে ফেলছে।
ধান সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি : চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রার পূরণ হলেও ধান সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও পূরণ করতে পারেনি সরকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কম উৎপাদন, ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন, আর্দ্রতার সমস্যা এবং স্থানীয় বাজারে দাম বেশি হওয়ায় সরকারের গুদামে ধান কম বিক্রি করেছে কৃষক।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বোরো সংগ্রহ মৌসুমে সরকার ৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২ লাখ ৬৮ হাজার টন ধান সংগ্রহ করেছে। যা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫৮.৭৬ শতাংশ কম।
জানা যায়, সরকার এবার বোরো মৌসুমে সারা দেশ থেকে ১০৮০ টাকা মন হিসাবে ধান কিনেছে। কিন্তু সরকারি সংগ্রহ কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই খোলাবাজারে দাম এর কাছাকাছি ওঠে এবং কিছুদিন পরই এর চেয়ে বেশি দাম হয়ে যায়।
যে কারণে কৃষকরা সরকারের কাছে ধান বিক্রিতে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। এছাড়া কোনো কোনো অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ধান সংগ্রহ কম হয়েছে।
তবে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের মতে, এবার কৃষক ধানের ভালো দাম পেয়েছে। ধান কেনার মূল লক্ষ্যই থাকে একটা প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা, যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করতে পারে।
ধান ছাড়াও ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সিদ্ধ চাল ১১ লাখ টন সংগ্রহের বিপরীতে ১১ লাখ ২১ হাজার ৯১০ টন এবং আতপ চাল ৫০ হাজার টনের বিপরীতে ৫৫ হাজার ২০৮ টন সংগ্রহ হয়েছে।
বাড়ছে সংকটকালীন নিরাপদ মজুতের পরিমাণ : সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা মজুত সাড়ে ১০ লাখ টন থেকে ১৩ লাখ টন এবং সংকটকালীন মজুত ১৪ লাখ টন নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি।
বর্তমান সরকারি সংগ্রহ ও বিতরণের মৌসুম পরিবর্তন বিবেচনায় সাড়ে ১০ লাখ টন খাদ্যের নিরাপত্তা মজুত ধরা হয়।
খাদ্যভান্ডারে এখন থেকে আরও বেশি পরিমাণ মজুত করা হবে। যদিও গত শনিবারের হিসাবে সরকারের ভান্ডারে ১৬ লাখ ১৭ হাজার টন খাদ্য মজুত রয়েছে।