আমাদের তিনটি প্রধান দৈনিকের সোমবারের প্রথম পাতার শিরোনাম :’বেপরোয়া ছাত্রলীগ ফের আলোচনায় :কুয়েটে লাঞ্ছনার পর শিক্ষকের মৃত্যু, আনন্দ মোহনে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, প্রেস রিলিজের কমিটি গঠন নিয়ে বিতর্ক’ সমকাল; ‘ফের বন্ধ হয়েছে কুয়েট ও আনন্দ মোহনের ছাত্রাবাস’ যুগান্তর; ‘কুয়েট শিক্ষকের অস্বাভাবিক মৃত্যু :জড়িতদের স্থায়ী বহিস্কারের দাবি শিক্ষক সমিতির’ ইত্তেফাক। এছাড়াও অন্যান্য সংবাদপত্রে ভেতরের পাতায় গুরুত্ব সহকারে তথাকথিত ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে খবর ছাপা হয়েছে। কয়েক দিন আগে আমরা দেখেছি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দুই রাজনীতিবিদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি, যাতে ২৯ জন ছাত্র বহিস্কৃত হয়েছে এবং অন্তত একজন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে এখনও বেঁচে আছে। এর আগে সহপাঠীদের দ্বারা বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের নির্মম হত্যার কাহিনি আমরা দেখেছি।
উপরোক্ত প্রতিবেদনগুলোতে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। বস্তুত সাম্প্রতিককালে আমরা ছাত্র রাজনীতির নামে যা দেখছি তা হলো ছাত্রদের ব্যবহারের রাজনীতি। আমাদের রাজনীতিবিদরা ছাত্রদের ব্যবহার করছেন লাঠিয়াল হিসেবে, তাদের নিজেদের স্বার্থে। নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার সোপান হিসেবে। ছাত্র রাজনীতির নামে যেসব নৃশংসতা ও অমানবিক আচরণ আমরা দেখছি, তাতে যে কোনো বিবেকবান মানুষই চরমভাবে ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন হলেও, আমাদের বিবেকহীন রাজনীতিবিদদের এ ব্যাপারে টনক নড়ার কোনো লক্ষণ দেখতে পাই না। বরং দুই-একজনের মধ্যে নরম সুরে সাফাই গাওয়ার প্রবণতা দেখতে পাই। কারণ তারা তাদের স্বার্থের ঘোরে বিভোর।
ছাত্র রাজনীতির নামে আজ যা হচ্ছে, তা মূলত অপরাধ কর্মকাণ্ড, যা দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য। আমাদের দণ্ডবিধির ১৫৩(৩) ধারা অনুযায়ী, ‘যে কেউ উচ্চারিত বা লিখিত কোনো কথা বা দৃশ্যমান কোনো প্রতীক দ্বারা বা অন্য কোনোভাবে কোনো ছাত্রকে বা ছাত্রগোষ্ঠীকে অথবা ছাত্রদের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট বা ছাত্রদের ব্যাপারে আগ্রহান্বিত কোনো প্রতিষ্ঠানকে কোনোরূপ রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে প্ররোচনা দান করে, যা জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত বা ক্ষুণ্ণ করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, সে দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড বা জরিমানা দণ্ড বা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’ আইনের এ বিধিনিষেধ জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ বা বিঘ্নিত করার কারণে এটি সংবিধানের সমাবেশ ও সংগঠিত করার স্বাধীনতার (অনুচ্ছেদ ৩৭ ও ৩৮) মৌলিক অধিকারেরও পরিপন্থি। এ হলো আমাদের দেশে আইনের শাসনের নমুনা!
আমাদের ছাত্র রাজনীতি এমন ছিল না। বস্তুত আমাদের দেশের ছাত্র রাজনীতির একটি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। অতীতে ছাত্র রাজনীতি ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা পরিচালিত হতো। নিজেদের স্বার্থ রক্ষা ও সমস্যা সমাধানের মধ্যেই তারা নিবিষ্ট ছিল। এ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চাসহ নানা ধরনের ‘এক্সট্রা কারিকুলাম’ কার্যক্রম পরিচালিত হতো, যা শিক্ষার্থীদের মেধা, সৃজনশীলতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে অবদান রাখত। সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাই তখন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতো। ছাত্র সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেই মূলত তারা সংগঠিত হতো; রাজনৈতিক ‘বি’ টিম হিসেবে নয়। লেজুড়বৃত্তির পরিবর্তে নৈতিকতাই ছিল মূলত ছাত্র সংগঠনগুলোর উৎস শক্তি। কিছু সংগঠন ছিল কট্টর আদর্শভিত্তিক। ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বহুলাংশে প্রতিবাদী এবং ক্ষমতাবিরোধী।
আমি নিজেও ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। স্কুলে পড়াকালীন আমি ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হই। আমার এই সম্পৃক্ততা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব শেষ হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ সময়ে আমি নওয়াব ফয়জুননেসা কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি (সহসভাপতি) নির্বাচিত হই। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক হল) প্রথমে সাহিত্য সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। ওই সময়ে আমি ৬ দফার আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘৬৯-এর গণআন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ি। আমার এই সম্পৃক্ততার পেছনে এ দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা ও কল্যাণ ছাড়া কোনো কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল না। এ সময়ে আমাকে ডাইনিং হলের বেয়ারাদের নাইট স্কুলে পড়িয়ে, টিউশনি করে এবং বৃত্তির অর্থ দিয়ে আমার নিজের খরচ মেটাতে হয়েছে। এমনকি আমাকে মাস্টার্স পরীক্ষার আগেই অর্থনৈতিক কারণে একটি কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নিতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আমি ‘৬৯-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি।
এখন ছাত্র রাজনীতি পরিচালিত হয় মূলত অছাত্রদের মাধ্যমে, যাদের অধিকাংশেরই লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকে না। তারা মূলত তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলের স্বার্থ রক্ষা করে; ছাত্রছাত্রীদের নয়। তাদের পৃষ্ঠপোষক দলের ছত্রছায়ায় তারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির মতো আর্থিক সুবিধা নেয়। একই সঙ্গে পৃষ্ঠপোষকের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা পায়। অনেক সময় তারা ভর্তি ও আবাসিক হলে সিট বাণিজ্য এবং দখলদারিত্বে লিপ্ত হয়। বস্তুত রাজনৈতিক দলের লেজুড় সংগঠনগুলো আজ বহুলাংশে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বৃত্তায়ন, চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অপকর্মে লিপ্ত। তাদের এসব অপকর্ম এবং এক দল বিবেকহীন শিক্ষকের অপরাজনীতির কারণে আমাদের শিক্ষার মানে ধস নেমেছে। তাদের এই অপরাজনীতির প্রভাব আমাদের জাতির জন্য অকল্যাণ বয়ে আনছে।
আমরা দেখেছি, বিশ্বের প্রযুক্তি খাতের প্রভাবশালী ১৭টি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এখন ভারতীয়। এটি ভারতের জন্য ঈর্ষণীয় অর্জন নিঃসন্দেহে। এ অর্জনের পেছনে তাদের শিক্ষার মান বিশেষ করে ভারতের আইআইটিগুলোর শিক্ষার মান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে নিঃসন্দেহে। দুর্ভাগ্যবশত, এমন মানসম্মত প্রতিষ্ঠান দেশে একটিও নেই। বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোতেও লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষকদের দলবাজি এবং অযোগ্যদের উচ্চ পর্যায়ে নিয়োগের ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানে অবনতি ঘটেছে। এসবের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আজ বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রতিবেশী ভারতের ছাত্রছাত্রীদের থেকে কোনো অংশে কম মেধাবী নয়। সুযোগ পেয়ে তারাও দেখিয়ে দিয়েছে- আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তারা ভারতীয়দের ছাড়িয়ে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে গণিত অলিম্পিয়াডের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের গণিত অলিম্পিয়াড দল দুই দুইবার আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ভারতীয়দের থেকেও বেশি নম্বর পেয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনৈতিক বিবেকহীনতা এবং আমাদের শিক্ষক সমাজের অনেকের অনৈতিকতা ও লেজুড়বৃত্তি আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা ও সৃজনশীলতার পথে বাধা হয় দাঁড়িয়েছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা। রাজনৈতিক দলের অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিলুপ্তি জরুরি, যাতে ছাত্রদের স্বার্থে এবং তাদের কল্যাণেই ছাত্র সংসদকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি গড়ে উঠতে পারে। প্রসঙ্গত, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ২০০৭ সালে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের সময় তাদের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠন বিলুপ্তির অঙ্গীকার করেছিল। সেই অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে বাহাত্তরের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ সংশোধন করে রাজনৈতিক দলের শর্ত হিসেবে তাদের গঠনতন্ত্রে সহযোগী সংগঠনের বিধান না রাখার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিধানটি প্রথমে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে অন্তর্ভুক্ত হলেও পরে এটি নবম জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের রাজনীতিবিদরা তাদের কথা রাখেননি। তারা তথাকথিত ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে এসব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছে। ক্ষমতাসীন দলের লেজুড় সংগঠন ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণের মাধ্যমে জাতি হিসেবে আমরা যার মাশুল দিচ্ছি।
আমার যতটুকু মনে পড়ে, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি শর্ত দিয়েছিলেন- প্রধান বিরোধী দল রাজি হলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধে তিনি উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত। আমি আশা করব, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। একই সঙ্গে প্রত্যাশা থাকবে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবে। এর মাধ্যমে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর সুফল অর্জন করে জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ আরও প্রশস্ত হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)