আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণপ্রাপ্তির বিপরীতে বাংলাদেশকে আগামী চার বছর ব্যাপক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ২০২৬ সালের মধ্যেই ধাপে ধাপে নানা খাতের এসব সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। এ সময়কালে চার কিস্তিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেবে আইএমএফ। ইতোমধ্যেই প্রথম কিস্তির টাকা পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইএমএফ যেসব সংস্কারের শর্ত দিয়েছে, তা দেশের জন্য ইতিবাচক এবং এক সময় এর দারুণ ফল পাওয়া যাবে।
পলিসি রিসার্র্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আইএমএফ যেসব শর্তের কথা বলেছে, আমরা তা আগে থেকেই বলে আসছি। এ সংস্কারগুলো দেশের অর্থনীতির জন্য অবশ্য প্রয়োজন। যৌক্তিক এসব শর্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে এর সুফল মিলবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদের কথায়ও আহসান এইচ মনসুরের প্রতিধ্বনি পাওয়া গেছে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আইএমএফ যেসব সংস্কারের কথা বলেছে, তা নতুন কিছু নয়। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব সমস্যা রয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে আইএমএফ চিহ্নিত সংস্কারগুলো করা দরকার। আইএমএফ সংস্কারের শর্ত দিয়েছে মূলত অর্থনীতিতে যেসব দুর্বলতা রয়েছে, তা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে যেন বাংলাদেশ সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
২০২৪ সালের জুনের মধ্যে মধ্যমেয়াদি রাজস্ব কৌশল প্রণয়ন, করনীতি পরিপালনের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, রাজস্ব জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো, ব্যাসে থ্রি অনুসারে ব্যাংকের খারাপ সম্পদের তালিকা প্রকাশ, ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থ্রা বাস্তবায়ন পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণ, দেউলিয়া ও অর্থঋণ আদালত আইন সংসদে উত্থাপন এবং সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি, সরকারি গ্যারান্টি, পিপিপিজনিত ঝুঁকিসহ সরকারের রাজস্ব ঝুঁকির তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
২০২৫ সালের মধ্যে কর অব্যাহতি কমাতে হবে। জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, মধ্যমেয়াদি রাজস্ব কৌশল বাস্তবায়ন, কর সংক্রান্ত নিয়মকানুন প্রতিপালনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, জ¦ালানির মূল্য নির্ধারণে সময়ভিত্তিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, জ্বালানির মূল্য সমন্বয় অব্যাহত রাখা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি ও বিতরণ ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানো, খেলাপি ঋণ কমানো ও মূলধন ঘাটতি দূর করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা, ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, সংশোধিত হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন সংসদে উত্থাপন, সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার কমানোর ধারা অব্যাহত রাখা, সরকারি মালিকানাধীন ৫০ সংস্থার তথ্য প্রকাশ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি অনুসারে সুদহারের ক্ষেত্রে পরিচালনাভিত্তিক পরিবর্তন অব্যাহত রাখা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা প্রয়োগের সক্ষমতা বাড়ানো।
২০২৬ সালের মধ্যে কর অব্যাহতি কমানো, জিডিপির দশমিক ৭ শতাংশ বাড়তি কর আহরণ, মধ্যমেয়াদি রাজস্ব কৌশল বাস্তবায়ন, কর সংক্রান্ত নিয়মকানুন, প্রতিপালনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে সময়ভিত্তিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো, খেলাপি ঋণ কমানো ও মূলধন ঘাটতি দুর করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা, ব্যাংকের তদারকি বৃদ্ধির কাজ অব্যাহত রাখা এবং আর্থিক খাতের জন্য খাতভিত্তিক কৌশল নির্ধারণ।
আইএমএফ মনে করে, পৃথিবীর যেসব দেশে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তার একটি। কর আদায় কম হওয়ায় প্রয়োজনীয় খাতে যথেষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ করা যায় না। তাই আগামী জুনের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে আইএমএফ। আগামী বাজেটেই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে। আইএমএফ বলছে, বাড়তি অর্থ পাওয়া গেলে অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোতে বাংলাদেশ আরও বেশি খরচ করতে পারবে।
এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক এবং ভ্যাট বিভাগে কমপ্লায়েন্স ঝুঁঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। আর এটি করতে হবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে। মূলত রাজস্ব আদায় বাড়াতে এ পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। দেশজ উৎস থেকে যে পরিমাণ অর্থ বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যবহার হয়, অর্থাৎ সরকার যত ঋণ করে, তার এক-চতুর্থাংশের কম নিতে হবে সঞ্চয়পত্র থেকে। সে লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সরকার প্রতিবছর বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ বাবদ বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখে। আইএমএফ চায়, সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ খাতে খরচ কমিয়ে অগ্রাধিকার খাতে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করুক। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। জানা গেছে, বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণের ১৪০ কোটি ডলার পেয়েছে রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায়।