নদীর ওপর ঝুলছে সেতু। কিন্তু সেই সেতু কাজে আসছে না। দেড় শ’ ফুট সেতুর অংশ বিশেষ ধ্বসে পড়ায় তা ব্যবহার হচ্ছে না। সেই সেতু পার হতে হচ্ছে খেয়া নৌকায়। তাতে সময়-অর্থ দুটোই অপচয় হচ্ছে। সেতু ধ্বসের দুই মাস পেরিয়ে গেছে। সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়ায় চরম ঝুঁকি নিয়ে মনিরাদের নদী পারাপার হতে হচ্ছে। মনিরারা জানেন না কবে নাগাদ খেয়া নৌকা ছেড়ে সেতু দিয়ে স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মনিরা আক্তার। লেখাপড়া করছে পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়নের খারিজা বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলে যেতে প্রতিদিনই মনিরাকে ছোট্ট একটি খেয়া নৌকায় চরম ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপার হতে হয়। কারণ এলাকার জমির মৃধা সেতুটির ভেঙে নদীতে পরায়, তাদের এ দুর্ভোগ।
শুধু মনিরার মতো স্কুল শিক্ষার্থীরাই নয় সেতুটি ভেঙে পরায় তাদের ইউনিয়ন দুই ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সাত বছর তিন মাস আগে সেতুটি বিধ্বস্ত হলেও এখনো মেরামত কিংবা নতুন করে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেই। এ অবস্থায় ইউনিয়নবাসী উপজেলার সাথে সহজ যোগাযোগ, লেখাপড়া, জরুরী স্বাস্থ্য সেবাসহ সকল কার্যক্রম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় সূত্র জানায়, বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুতাবড়িয়া শাখা নদী। নদীর পূর্ব পাড়ে মরদানা, গরমআলী, জাফরাবাদ গ্রামসহ খারিজাবেতাগী ও তফালবাড়ীয়া গ্রামের একাংশ। আর পশ্চিম পাড়ের গ্রামগুলো হচ্ছে রামবল্লভ, দাবাড়ি, চিংগরীয়া, চন্দ্রাবাজসহ খারিজা বেতাগীর এবং তফালবাড়ীয়ার অপর অংশ। এই ১১ গ্রামবাসীর সহজ যোগাযোগ সংযোগ ছিল জমির মৃধা বাজার এলাকার খারিজা বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন লাহার বিমের উপর আরসিসি কংক্রিট ঢালাইয়ের এই সেতু। পূর্ব পাড়ের লোকজন নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার-হাট, জরুরী স্বাস্থ্য সেবার কমিউনিটি ক্লিনিক, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার জন্য পশ্চিম পাড়ে আসতে হয়। অন্যদিকে, পশ্চিম পাড়ের লোকজনদের সরাসরি উপজেলা সদরে যোগাযোগে এই সেতু পার হয়ে যেতে হতো।
এলজিইডি দশমিনা উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় জানান, ইউনিয়নবাসীর সহজ যোগাযোগের জন্য দশমিনার উপজেলার ঠাকুরের হাট সংলগ্ন পরিত্যাক্ত লোহার সেতুটি সড়িয়ে এনে বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়নের জমির মৃধা বাজার এলাকায় স্থাপন করা হয়েছিল। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে এ সেতু স্থাপন করতে ব্যয় হয় ১০ লাখ টাকা। লোহার বিমের উপর আরসিসি কংক্রিট ঢালাইয়ের ১৫০ ফুট লম্বার এই সেতুর মাঝখানে প্রায় ২৫ ফুট অংশ ভেঙে নদীতে পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে দুই পাড়ের মানুষজন।
সরেজমিন দেখা যায়, বিদ্যালয়ে পাঠদান নিতে শিক্ষার্থীরা ছোট্ট একটি ডিঙ্গি খেয়া নৌকায় নদী পাড় হচ্ছে। এই শিক্ষার্থীরা নদীর পূর্ব পাড়ের বাসিন্দা। এরা পশ্চিম পাড়ের খারিজা বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী।
ওই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মনিরা আক্তার বলেন, ‘ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক স্কুল। সেতু ভেঙে পড়ায় এখন তাদের এলাকার শিক্ষার্থীদের এখন ঝুঁকি নিয়ে নদী পাড় হয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে।’
খারিজা বেতাগী গ্রামের নাসির উদ্দিন ওই বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। সে জানায়, ‘ছোট্ট নৌকায় নদী পার হতে খুব ভয় করে তাদের। তারপরও লেখাপড়ার জন্য কষ্ট করে স্কুলে আসতে হচ্ছে।’
জাফরাবাদ গ্রামের সুমাইয়া ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। সুমাইয়া জানায়, ‘এখন আর প্রতিদিন তার স্কুলে আসা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ি থেকে একা স্কুলে পাঠাতে চায় না। সুমাইয়া প্রতিদিন স্কুলে আসতে চায়।’
খারিজা বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: হিরন আহমেদ বলেন, ‘খারিজা বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী ও খারিজা বেতাগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ২০০ শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে। এদের মধ্যে কমপক্ষে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী নদীর পূর্ব পাড়ের বাসিন্দা। সেতুটি বিধ্বস্ত হয়ে পরায় এখন শিশু শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কমে গেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সেতুটি যখন ভেঙে পরেছিল তখন একটি শিশু মারা গিয়েছিল। এখন শিক্ষার্থীরা ছোট্ট খেয়া নৌকায় পারাপার হচ্ছে। এতে করে সবসময় আমাদের একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়, কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলো কি-না।’
এ দিকে, স্কুল থেকে দক্ষিণ দিকে একটু হেঁটে জমির মৃধা বাজারে দেখা যায়, খারিজা বেতাগী কমিউনিটি ক্লিনিক। একজন রোগী সেখানে সেবা নিচ্ছেন।
কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রভাইটর ফারিয়া সুলতানা জানায়, ‘ইউনিয়নে দু’টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে একটি দশমিনা-পটুয়াখালী সড়কের ঠাকুরের হাট এলাকায় অপরটি এই জমির মৃধা বাজারে। এখানে এক সময় প্রচুর রোগী আসত। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুর সংখ্যাই ছিলো বেশি।’
তিনি আরো জানান, ‘সেতুটি ভেঙে পরার পর এখন নদীর পূর্ব পাড়ে নারী-শিশু রোগী খুব কমই আসছে। খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে গর্ভবতী মা ও শিশুদের আসা-যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পরায় রোগীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে।’
বাজারের ব্যবসায়ী মো: জাহাঙ্গীর মেলকার বলেন, ‘সেতুটি ভেঙে পড়ার পর বাজারে ব্যবসা বানিজ্যে ভাটা পড়েছে। পূর্ব পাড়ের মানুষ তাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় মালামাল কিনতে সরাসরি বাজারে চলে আসতো। কিন্তু এখন তেমন লোকজন আসে না। ওই পাড়ের লোকজন উপজেলা সদরে চলে যাচ্ছে।’
বেতাগী সানকিপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মসিউর রহমান ঝন্টু বলেন, ‘আসলে সেতুটি ভেঙে পড়ায় আমার ইউনিয়ন এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পুরোনো সেতু স্থাপন করা হলেও মজবুত ছিলো না। এখন নতুন করে একটি সেতুর জন্য দশমিনা উপজেলা পরিষদ, এলজিইডি কার্যালয়ে অবহিত করা হয়েছে।’
এলজিইডি দশমিনা উপজেলা প্রকৌশলী মকবুল হোসেন বলেন, ‘বালু ভর্তি কার্গোর ধাক্কায় লোহার সেতুটি বিধ্বস্ত হয়। তবে এখন আর সেখানে লোহার সেতু নির্মাণ সঠিক হবে না। এছাড়াও সেতু স্থানে নদী ভাঙ্গন, তাই স্থান পরিবর্তন করে আরসিসি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু মাটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, ব্রিজ নির্মাণের উপযোগী নয় স্থান।’
উল্লেখ্য, পটুয়াখালীর দশমিনার খারিজা বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সুতাবাড়য়িা শাখা নদীর উপর লোহার সেতুটি ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে ভেঙে পড়ে। বালু বোঝাই একটি কার্গোর ধাক্কায় সেতুর মাঝখানের অংশ ভেঙে নদীতে পড়ে যায়। এ সময় সেতুর উপর থাকা চার শিশুসহ পাঁচজন নদীতে পড়ে যায়। চারজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও নুরসাত জাহান (৫) নামে একটি শিশু নিখোঁজ হয় এবং ঘটনার পাঁচদিন পর সেতু ভেঙে পরার স্থান থেকে নুরসাতের লাশ ভেসে উঠে। এ ঘটনায় পুলিশ কার্গোর চালক, হেলাপারকে আটক করেছে এবং একটি মামলা দায়ের হয়েছে।