বৃহস্পতিবার, ১২:৪০ পূর্বাহ্ন, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।
শিরোনাম :
জানুয়ারির প্রথম দিকেই নতুন বই পাবে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শ্রমিক আন্দোলনে ইন্ধন দেয়ার অভিযোগে টিএনজেড গ্রুপের পরিচালক গ্রেফতার চট্টগ্রামে ফোম কারখানায় ভয়াবহ আগুন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার গাড়ির ওপর উঠে গেলেন আন্দোলনে আহতরা শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ বলা মূল সংবিধানের কনসেপ্টের পরিপন্থী : অ্যাটর্নি জেনারেল পৃথিবীর সুরক্ষায় ‘জিরো কার্বন’-ভিত্তিক জীবনধারার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার গৌরনদীতে দৈনিক যুগান্তরের বিরুদ্ধে বিড়ি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই হবে বইমেলা : সংস্কৃতি উপদেষ্টা তৌহিদ আফ্রিদির বিয়ে নিয়ে ধোঁয়াশা শহীদ-আতিক-মেহেদীসহ ৪ জন রিমান্ডে

১২ নভেম্বর এলেই আঁতকে ওঠেন ভোলার বাসিন্দারা

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৩
  • ৩৩ বার পঠিত

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর রাত; উপকূলীয় জেলাগুলোয় আঘাত হেনেছিল মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘হারিকেন’। সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের তোড়ে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় জলোচ্ছ্বাস।

৩০ ফুট উচ্চতার এ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগের প্রশাসনিক অঞ্চল ভোলা জেলা।
প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু সংখ্যাটা ছিল দ্বিগুণ।

ভোলার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২ নভেম্বর ভোর সাড়ে তিনটার দিকে বাতাস ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। শো শো বাতাস না কাটতেই চারদিক পানিতে তলিয়ে যায়। বাড়ির পর বাড়ি, গ্রামের পর গ্রাম- মানুষের বাঁচার আকুতি। পানিতে রাস্তা তলিয়ে যাওয়া, বড় বড় গাছ ভেঙে মানুষ হতাহত, দিনটি মনে করে এখনও আতঙ্ক ভর করে জেলার মানুষের মনে।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর তারিখটির ব্যাপারে কথা বলে ভোলার মদনপুর উপজেলার বাসিন্দা অজিউল্লাহর সঙ্গে। তিনি জানান, ওই রাতে তার সামনেই পরিবারের ৮ সদস্য পানিতে ভেসে যায়। ছোট বোন রাশিদা ছাড়া বাকি কাউকেই তিনি পরে আর খুঁজে পাননি। ৪ বছরের রাশিদাকে তিনি পেয়েছিলেন খেজুর গাছের ওপর.. মৃত।

ঝড় থামার পর পানি নেমে যেতে শুরু করলে মাঠে-ঘাটে শুধু লাশ দেখতে পান অজিউল্লাহ। লাশগুলোর অবস্থায় এমন ছিল, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল জীবন রক্ষার জন্য তারা নিজেরাই কতটা যুদ্ধ করেছিলেন। নিজ চোখে অজিউল্লাহ দেখেছেন- কতজনের লাশ ঝুলে আছে গাছে। কারও লাশ কাঁদাপানিতে। গ্রামগুলো কান্না-আহাজারি। বহু মানুষের লাশ পানিতে ভেসে কোথায় গেছে, বলতে পারে না কেউ।

মদনপুরের এ বাসিন্দা জানান, তিনি ৫ যুবতীকে পানির তোড়ে ভেসে আসতে দেখেছেন। তারা বেঁচে ছিল। অজিউল্লাহর বাবা মোজাম্মেল হক ওই পাঁচজনের প্রাণ রক্ষায় দৌড়ে গিয়েছিলেন। চারদিকে পানি থাকায় ভুক্তভোগীদের চুল গাছের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন বেঁচে গিয়েছিলেন। বাকিরা মারা যান। ঘটনাটি ঘটেছিল চরফ্যাশন উপজেলার নুরাবাদ গ্রামে।

বাসু, সামসুদ্দিন, আবদুল মালেক, হাফেজ ফারুক, মজিবুল হক, মো. ইউসুফসহ কয়েকজন ভুক্তভোগীও সত্তরের সেই ভয়ানক রাতের কথা বর্ণনা করেন। সবার কথাই প্রায় এক। এদের মধ্যে কেউ পরিবারের সদস্য হারিয়েছেন। কেউ সম্পদ।

ইউসুফ জানান, ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে পানি বাড়তে থাকায় তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী করবেন। ওই রাতে তার পরিবারের সাত সদস্য হারিয়ে যায়। একটি গাছে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন।

মদনপুরের মজিবুল হক জানান, সেই ঘূর্ণিঝড়ে তার বাবাসহ পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু হয়। সাত জনের পরিবারের সবাই একটি বড় গাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তার বাবা প্রাণ হারান।

যতজনই ওই রাতের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, কেঁদে ফেলছিলেন। চোখের সামনে স্বজন হারানোর বেদনা আজও তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।

১২ নভেম্বর ১৯৭০, এই তারিখে শুধু ভোলাতেই প্রাণ হারান ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। গাছে, মাটিতে যেমন মরদেহ পাওয়া যাচ্ছিল, ঘূর্ণিঝড়ের পর নদীতেও মানুষ-গবাদিপশুর লাশ ভেসে যেতে দেখা যায়।

 

সেই ঝড়ে দ্বীপজেলা ভোলার ৭ উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাওলানা ভাসানী উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে ছুটে আসেন। দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেন তারা।

তুলাতলী এলাকার বাদশা মিয়া বলেন, ওই রাইতের পর মেলা মাইনষ্যের লাশ টোগাইসি; উদ্ধার করসি। কতজনের লাশ নদী দিয়া ভাইস্যা গেসে, ঠাওর নাই।

শাহে আলম, রহমত আলী, ছিদ্দিক ও সিরাজ উদ্দিন নামে কয়েকজন স্থানীয় বলেন, মদনপুরের ১৮টি ঘরের মধ্যে ৪০ জনের মরদেহ পাওয়া যায়। একটি পরিবারে কেউ বেঁচে ছিল। না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন উপজেলায়।

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এ ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। আঘাত হানার সময়ে ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২৫০ কিলোমিটার আর ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের গড় গতি ছিলো ১৮৫ কিলোমিটার।

বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়টি পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঝড় হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। ২০২২ সালের ১৮ মে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতী আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে। তালিকার শীর্ষ প্রাণঘাতী ঘটনা হিসেবে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ ঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। সরকারি হিসেবে এতে ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষ মারা যান; তবে বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি ছিল।

মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হারিকেনের আঘাত আজ থেকে ৫৩ বছর আগে এলেও উপকূলবাসীদের উন্নয়ন যে খুব হয়েছে, তা বলার জো নেই। এই অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদেরই। তারা বলেন, উপকূলে একের পর এক দুর্যোগ আঘাত হানলেও আজও উপকূলবাসীর জন্য টেকসই বেড়িবাঁধ বা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ হয়নি। প্রতিবছরই ছোট-বড় ঝড় আঘাত হানে। মানুষ এখনও মৃত্যু ঝুঁকিতে ভোগে। কিন্তু এসব থেকে নিস্তার পেতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

প্রবীণ সাংবাদিক ও ভোলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এম হাবিবুর রহমান, সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সব জেলায় মানুষ আর গবাদি পশু বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলে ভেসে গেছে। মানুষ শূন্য হয়ে পড়েছিল দ্বীপজেলা ভোলা। ভয়ানক সেই ঝড়ের কথা এখনো ভোলেনি উপকূলের মানুষ। এখনও আতঙ্ক তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।

আগামীকাল রোববার ১২ নভেম্বর। দিনটিকে উপকূল দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবিতে ভোলায় বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন ও আলোচনা সভার হবে। উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটি এ আয়োজন করেছে। কমিটির উদ্যোক্তা উপকূল সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, এ বছর দেশের ৫০টি জেলায় দিবসটি পালিত হবে। আয়োজনে ভয়াল দিনটিকে ভুক্তভোগী আহত, নিহত সবাইকেই স্মরণ করা হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com