শেখ হাসিনা সরকারের আমলে প্রতিবছরই উৎপাদন খাতে ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। এমনকি মোট জিডিপিতে উৎপাদন খাতের অবদান ১৭.২৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৩.১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলেও দাবি করেছিল তারা। তবে উৎপাদন খাতের হাত ধরে শিল্প খাতে বছরের পর বছর ধরে দেখানো জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই হিসাব মিলছে না বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রাথমিক ফলাফলে। বিবিএসের জরিপ বলছে, দেশের অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোতে গত ১১ বছরে শিল্প খাতের অবদান কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৭৭ শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ছিল ১১.৫৪
শতাংশ। এ ছাড়া গত ১১ বছরে দেশে অর্থনৈতিক ইউনিটের প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে। সার্বিকভাবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গতিও ছিল কম। অর্থনৈতিক ইউনিট পরিচালনায় নারী নেতৃত্ব এবং কর্মসংস্থানও কমেছে।
গতকাল রাজধানী আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্মেলন কক্ষে অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতি সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভাপতি ড. কেএএস মুর্শিদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। বক্তব্য দেন প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালক এসএম শাকিল আখতার।
বিবিএসের হিসাবে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে উৎপাদন (ম্যানুফেকচারিং) খাতে মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৯৭ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৩২ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ১১ বছরে উৎপাদন খাতের মোট উৎপাদন মূল্য প্রায় ৫.৭৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার প্রতিবছর গড়ে ১৪ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ধস নামার বছরেও (২০১৯-২০ অর্থবছরে) এই খাতে ৪ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতিবছরই উৎপাদন খাতে ডাবল ডিজিট, এমনকি কোনো কোনো বছর ১৮ শতাংশ ছুঁইছুঁই প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। এ সময় মোট জিডিপিতে উৎপাদন খাতের অবদান ১৭.২৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৩.১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলেও দাবি করে হাসিনা সরকার।
অর্থনৈতিক শুমারির প্রাথমিক হিসাব বলছে, গত ১০ বছরে উৎপাদন খাতে অর্থনৈতিক ইউনিটের (প্রতিষ্ঠান) সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১৫.৩৯ শতাংশ। অথচ ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময়ে পরিচালিত শুমারির তুলনায় ২০১৩ সালের শুমারিতে এই খাতে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা বেড়েছিল ১০০.৪২ শতাংশ। অর্থাৎ সার্বিকভাবে দেশে অর্থনৈতিক ইউনিটের প্রবৃদ্ধিও কমেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠানে তুলনামূলক কম প্রবৃদ্ধি হওয়ায় অর্থনৈতিক ইউনিটে এই খাতের অবদান ৮.৭৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৩ সালে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটে উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১২.১৪ শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ১১.৫৪ শতাংশে নেমে আসে। এ হিসাবে টানা দুই শুমারিতেই কমেছে উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠানের (ইউনিট) অবদান। অন্যদিকে গত ১০ বছরে সেবা খাতের ইউনিটের সংখ্যা ৬৯ লাখ ১৫ হাজার ৯৮২ থেকে ৫৬.৬৮ শতাংশ বেড়ে এক কোটি আট লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৬-এ দাঁড়িয়েছে। এর ফলে মোট ইউনিটে সেবা খাতের অবদান ৮৮.৮৬ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১.২৩ শতাংশে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গেল এক দশকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বেড়েছে ৪০ লাখ কোটি টাকা। এ সময়ে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের যুক্ত হয়েছে ৪০ লাখ ৫৮ হাজার খানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সার্ভিস তথা সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে ৩৯ লাখ ১৯ হাজারটি, আর উৎপাদন খাতে যুক্ত হয়েছে মাত্র এক লাখ ৩৮ হাজারটি। এ কারণে গত ১০ বছরে মাত্র ৬২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সাধারণত টেকসই উন্নয়নের জন্য কৃষি থেকে শিল্প এবং তারপর সেবা খাতে রূপান্তর হওয়া দরকার। কিন্তু বাংলাদেশ শিল্পায়নকে এড়িয়ে সরাসরি কৃষি থেকে সেবা খাতে প্রবেশ করছে। তিনি আরও বলেন, প্রচলিত শিল্পায়নের পরিবর্তে বিনিয়োগকারীরা ছোট, অনানুষ্ঠানিক পারিবারিক ইউনিট গড়ে তুলছেন, যা নিম্নমানের ও নিম্নআয়ের।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছর পর্যন্ত দেশে মোট অর্থনৈতিক ইউনিট দাঁড়ায় এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি। এর মধ্যে স্থায়ী ৬২ লাখ ৮৮ হাজার ২১৪টি, অস্থায়ী ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৬২১টি এবং ইকোনমিক হাউসহোল্ডে ৫০ লাখ ১২ হাজার ৫২৯টি। ঠিক এর এক দশক আগে অর্থনৈতিক ইউনিট ছিল ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এর মধ্যে স্থায়ী ছিল ৪৫ লাখ ১৪ হাজার ৯১টি, অস্থায়ী ছিল চার লাখ ৮২ হাজার ৯০৩টি। আর ইকোনমিক হাউসহোল্ড ছিল ২৮ লাখ ২১ হাজার ৫৭১টি। অর্থাৎ এক দশকে ৪০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৯টি অর্থনৈতিক ইউনিট বেড়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থনৈতিক ইউনিটের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ৮৩ লাখ ৪৬ হাজার ১৬১টি আর শহরাঞ্চলে রয়েছে ৩৫ লাখ ৩১ হাজার ২০৩টি। এর আগে ২০১৩ সালে গ্রামাঞ্চলে ছিল ৫৫ লাখ ৮৯ হাজার ১৯টি, শহরাঞ্চলে ছিল ২২ লাখ ২৯ হাজার ৫৪৬টি। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ৩৯ লাখ ৪১ হাজার ৬৮টি, শহরাঞ্চলে রয়েছে ২৩ লাখ ৪৭ হাজার ১৪৬টি; যা ১০ বছর আগে ছিল গ্রামাঞ্চলে ২৯ লাখ ৩৬ হাজার ৪৫৯টি আর শহরাঞ্চলে ছিল ১৫ লাখ ৭৭ হাজার ৬৩২টি। অস্থায়ী পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৬২১টির মধ্যে শহরাঞ্চলে রয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯০৯টি আর গ্রামে দুই লাখ ৯১ লাখ ৭১২টি; যা ২০১৩ সালে ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৬৯৩টি।
নারী নেতৃত্ব ও কর্মসংস্থানে হ্রাস : অর্থনৈতিক ইউনিট পরিচালনায় পুরুষের আধিপত্য এখনও ব্যাপক। ২০২৪ সালের শুমারি অনুসারে, ৯৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ ইউনিট পুরুষ দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালে তিন কোটি সাত লাখ ৬১ হাজার ৩৪ জন বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এর মধ্যে পুরুষ দুই কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার ২৯৮ জন। অন্যদিকে নারীদের পরিচালিত ইউনিটের সংখ্যা সাত লাখ ৬৮ হাজার ৪২টি, যা মোট ইউনিটের মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৩ সালের শুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ২১ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক দশকে অর্থনৈতিক ইউনিটে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে।
শুধু নেতৃত্ব নয়, কর্মসংস্থানেও নারীদের অংশগ্রহণ ২০১৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে কমেছে। দেশে বর্তমানে ৩.০৭ কোটি শ্রমিক কাজ করছেন, যাদের ৫৬.৮২ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে নিযুক্ত। এর আগে ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে কর্মসংস্থান বেড়েছিল এক কোটি ৩৩ লাখ। অর্থাৎ ২০১৩ সালে এসে কর্মসংস্থান বেড়ে দাঁড়ায় দুই কোটি ৪৫ লাখ ৮৫০। সে হিসাবে গত ১০ বছরে নতুন কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ৬২ লাখ ৬০ হাজার ১৮৪ জন।