মনোরম দৃশ্য ও দৃষ্টিনন্দন লেকের কারণে রাজধানীতে দর্শনার্থীদের অন্যতম পছন্দের স্থান হাতিরঝিল। ব্যস্ত নাগরিক কোলাহল থেকে কিছুটা স্বস্তির খোঁজে নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে প্রতিদিন এখানে ছুটে আসেন হাজার হাজার দর্শনার্থী। কেউ একাকী, কেউবা প্রিয়জন কিংবা পরিবার নিয়ে আসেন এই এলাকার মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করতে। দর্শনার্থীদের পছন্দের এই স্থানটি ক্রমেই যেন ভয় ও অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে। এখানে প্রায়ই ঘটছে ছিনতাই, ইভটিজিং, খুন, অপহরণসহ নানা রহস্যজনক ঘটনা। কিছু দিন পরপর লেকে ভেসে উঠছে নারী-পুরুষের লাশ। মাদকবাণিজ্য, যৌন হয়রানি, দেহব্যবসা, কিশোর গ্যাং ও বখাটেদের উৎপাত যেন এখানকার নৈমিত্তিক ঘটনা। এতদিন যে হাতিরঝিলকে নিরাপদ জায়গা মনে করা হতো, নানা অব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল নজরদারির কারণে এলাকাটি এখন অরক্ষিত ও
অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। পরিণত হয়েছে অপমৃত্যু এবং অপরাধের হটস্পটে। কিছু ক্ষেত্রে অন্যত্র হত্যার পর নিরাপদে লাশ ফেলতে হাতিরঝিলকেই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি উদ্বোধনের পর থেকে হাতিরঝিল এলাকা থেকে এ পর্যন্ত শতাধিক মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে লেকের পানিতে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩৬ জন এবং হত্যার শিকার হয়েছেন ২০ জনের বেশি। এ ছাড়া ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বেপরোয়া গতির যানবাহনে এখানে ঘটেছে শতাধিক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন অনেকেই। তবে এখানকার বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনাই ছিল রহস্যাবৃত্ত। এই এলাকায় দুই সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনা আজও রহস্যাবৃত্ত। এর মধ্যে একজন দুর্ঘটনায় এবং অন্যজন আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশ দাবি করলেও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়ায় এ দাবিকে মেনে নেননি অনেকেই।
জানা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে হাতিরঝিল লেক থেকে ২৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে গত ৭ মাসে ১৯ খুন, চারজনকে ধর্ষণ, ১৬ জনের আত্মহত্যা ও ১০টি ছিনতাইয়ের অভিযোগ জমা পড়েছে হাতিরঝিল থানায়। বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। লোকলজ্জা ও পুলিশি ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে ভুক্তভোগী অনেকে থানায় অভিযোগ না জানানোয় অনেক ঘটনা রয়ে গেছে হিসাবের বাইরে।
সর্বশেষ গত রবিবার হাতিরঝিল থেকে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর দক্ষিণখানের একটি স্কুলে পড়–য়া ওই কিশোরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে অপহৃত হন। হাত-পা বেঁধে পাঁচজন মিলে গণধর্ষণ করলে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে তাকে হত্যা করে মরদেহ বস্তাবন্দি করে পাষ-রা। হাতিরঝিলে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও ঘটনার দিনগত মধ্যরাতে (১৬ জানুয়ারি) মহাখালী থেকে রিকশাযোগে ওই কিশোরীর বস্তাবন্দি মরদেহ হাতিরঝিলের পুলিশ প্লাজার সামনের সেতুতে নিয়ে আসে খুনিরা। সুযোগ বুঝে লাশটি সেতু থেকে হাতিরঝিলে ফেলে হত্যাকারীরা যার যার মতো বাসায় চলে যায়। হত্যায় জড়িত রবিন ও রাব্বি মৃধা নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও অন্য তিনজনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এরপর গত ২৮ জানুয়ারি দুপুরে রাইড শেয়ারিং অ্যাপে গাড়ি ডেকে রাজধানীর বনশ্রী থেকে ধানমন্ডি যাওয়ার পথে হাতিরঝিল এলাকায় অপহরণের চেষ্টা করা হয় চিত্রনায়িকা নিঝুম রুবিনাকে। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযুক্ত উবারচালক মো. রকিকে গ্রেপ্তার করেছে।
স্থানীয়রা জানান, হাতিরঝিল নির্মাণ থেকে শুরু করে উদ্বোধনের পর পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করত সেনাবাহিনী। তখন কেউ অপরাধ করার সাহস পেত না। রাজউককে হাতিরঝিলের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর থেকেই অপরাধ বেড়ে গেছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতিরঝিল চলে যায় ভবঘুরে, ছিনতাইকারী, মাদকসেবীসহ অপরাধীদের দখলে। দিনেও থাকে বখাটেদের উৎপাত। ঘুরতে যাওয়া মানুষকে উত্ত্যক্ত করে বখাটেরা। হাতিরঝিলের সঙ্গে বেগুনবাড়ী, কুনিপাড়া, তেজগাঁও, বাড্ডা, উলন, মহানগর ও মধুবাগ এলাকায় অন্তত ৩৮টি গলি রয়েছে। সেতুগুলোর বিপরীত পাশে রয়েছে কিছু অন্ধকার এলাকা। সেসব এলাকায়ও নানা ধরনের অপরাধ হয়। পুরো হাতিরঝিল এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার কথা থাকলেও তা হয়নি। আবার কয়েকটি স্থানে সিসি ক্যামেরা থাকলেও সেগুলো নষ্ট। লেকের ছোট সেতুগুলোর অধিকাংশ বাতি নষ্ট। ঢিলেঢালা থাকে পুলিশের টহল। এসবের সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীচক্র।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২১ জুলাই মধুবাগ সেতুর উত্তর পাশ থেকে অজ্ঞাত এক পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২২ জুলাই রাতে এসএসসি পরীক্ষার্থী এক কিশোরী ঝিলের পানিতে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। ৭ এপ্রিল প্যাডেল বোট থেকে পড়ে মারা যান এক যাত্রী। ওই বছর ২৫ জানুয়ারি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিহত হন এক মোটরবাইকচালক। ২০২২ সালের ৮ জুন লেক থেকে বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজের প্রযোজক আবদুল বারীর গলা কাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে হাতিরঝিলে সড়ক দুর্ঘটনায় দৈনিক সময়ের আলোর সিনিয়র রিপোর্টার মো. হাবীবুর রহমান নিহত হন। তিনি কীভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা কাটেনি। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীচক্র হত্যার পর লেক এলাকায় এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিজানুর রহমানের মরদেহ ফেলে যায়। একই বছরের ১২ অক্টোবর সকালে হাত-পা রশি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় অজ্ঞাতনামা এক যুবকের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার কিছু দিন আগেই ব্র্যাক ব্যাংকের পরিচ্ছন্নতাকর্মী সিরাজুল ইসলামের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে আমবাগান এলাকায় প্রাইভেটকারের ভেতর থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০২০ সালের ৩ আগস্ট লেকের পাশে কাঁঠালগাছ থেকে এক ব্যক্তির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় হাতিরঝিলে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে।
যদিও হাতিরঝিলে কর্তব্যরত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের দাবি, পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো। ফলে আগের চেয়ে অনেকটাই স্বস্তি ফিরেছে। নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অপরাধমূলক কর্মকা-। কর্তব্যরত এক আনসার সদস্য বলেন, গত ৫ আগস্টের পর হাতিরঝিল থানা এলাকায় চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ও মাদক ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কড়া নজরদারির কারণে এখন সেগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। প্রায়ই মাদক বাবসায়ী, কিশোর গ্যাং ও বখাটে তরুণ-যুবককে আটক করা হচ্ছে।
হাতিরঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ রাজু আমাদের সময়কে বলেন, হাতিরঝিল থানা এলাকার অপরাধ পরিস্থিতি এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। স্কুলশিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এখানে ২৪ ঘণ্টা নিয়মিত টহল দিচ্ছেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। ফলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে রয়েছে।