স্বামীর অবৈধ সম্পদের মালিকানা পাচ্ছেন স্ত্রীরা। ফলে স্বামীর দুর্নীতির দায় নিতে হচ্ছে স্ত্রীকেও। জেনে-বুঝে কিংবা অগোচরে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়ে মামলার আসামি থেকে শুরু করে জেলের ঘানিও টানছেন অনেক নারী। গত ছয় বছরে দুদকের এক হাজার ৪০০ অবৈধ সম্পদের মামলায় স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীরাও আসামি হয়েছেন এক হাজার ১২০টি মামলায়। সিআইডিসহ পুলিশের মানিলন্ডারিং মামলার আসামিও হয়েছেন বিপুলসংখ্যক নারী।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা বলছেন, সম্পদের বৈধ উৎস দেখাতে না পারলে নারী-পুরুষ যেই হোন, তাকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই নারীদের চেকবই ও দলিলসহ স্ট্যাম্পে ভালোভাবে দেখে-শুনে সই করতে হবে। বেশিরভাগ মামলার তদন্তে দেখা গেছে, স্বামীদের দুর্নীতির সঙ্গী তাদের স্ত্রীরাও। স্বামী প্রকৃত আয়ের বাইরে যখন অস্বাভাবিক অর্থ ঘরে নিয়ে আসেন, তখন বেশিরভাগ স্ত্রী প্রশ্ন করেন না- এই টাকার উৎস কী। কিংবা স্ত্রীরা জেনেশুনেই অনেক ক্ষেত্রে স্বামীকে আরও অর্থ-বিত্তের মালিক হতে প্ররোচিত করে থাকেন। তাই স্বামীর অবৈধ সম্পদের দায় স্ত্রীদের রয়েছে বলে দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কামরুন নাহার পলি একজন গৃহিণী। তার কোনো বৈধ ব্যবসা কিংবা আয় নেই। তবে স্বামীর অবৈধ আয় দিয়ে তার নামে ঢাকার বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট, উত্তরায় পাঁচ কাঠার প্লট, সঞ্চয়পত্র ও ছয়টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক কোটি ৮৫ লাখ ৮৪ হাজার ৯৪৪ টাকার সম্পদ পেয়েছে দুদক। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক আনিস আহমেদের কোটিপতি স্ত্রী কামরুন নাহারকে দুদকের মামলায় গত ৭ সেপ্টেম্বর কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সহকারী পরিচালক আবদুল জলিল মিয়ার স্ত্রী মাহমুদা নাসরিনও গৃহিণী। বৈধ আয়ের কোনো উৎস না থাকলেও তার নামে ৪ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বামী ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক পাবনা কার্যালয়। স্বামীর ঘুষ ও দুর্নীতির টাকা নিজের নামে রাখায় ফেঁসে গেছেন মাহমুদা নাসরিন।
লেমন্ড অ্যাপারেলস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৬ লাখ ৯৪ হাজার ডলার বিদেশে পাচারের প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এই প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচারের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইকবাল চৌধুরী তার স্ত্রী আয়েশা বেগমকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। আয়েশা বেগম শুধু কাগজ-কলমে চেয়ারম্যান থাকলেও অর্থপাচারের ঘটনায় স্বামীর সঙ্গে তিনিও আসামি হচ্ছেন।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক নারী জানিয়েছেন, তারা অগোচরেই সম্পদের মালিক হয়েছেন। স্বামীর কথামতো দলিল ও চেকবইয়ে সই দিয়েছেন। ব্যবসা কিংবা ব্যাংকের বিষয়ে ধারণা না থাকায় স্বামীরা কৌশলে তাদের অবৈধ সম্পদের মালিক বানিয়েছেন। স্বামীর সম্পদ নিজের নামে নিয়ে তারা ফেঁসে গেছেন।
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আমাদের সময়কে বলেন, নারী-পুরুষ যে হোক সম্পদের বৈধ উৎস থাকতে হয়। বৈধ উৎস দেখাতে না পারলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। তবে দেখা যাচ্ছে, স্বামী তার অবৈধ আয়ে স্ত্রীর নামে সম্পদ গড়ছেন। স্ত্রী অনেক সময় জেনে-বুঝেই সেই সম্পদের মালিক হচ্ছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে না বুঝেই অবৈধ সম্পদের মালিক হচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে স্ত্রীরা আসামি হচ্ছেন।
মোশাররফ হোসেন কাজল আরও বলেন, একজন তার স্ত্রী ও সন্তানের নামে সম্পদ দিতেই পারে। এই সম্পদ বৈধ কিংবা অবৈধ যেটিই হোক না কেন, পরবর্তী সময়ে কমিশন সম্পদের উৎসের ব্যাপারে যখন জানতে চাইবে, স্ত্রীরা যদি বলেন এসব সম্পদ তাদের স্বামীদের মাধ্যমে হয়েছে। তা হলে স্ত্রীদের ব্যাপারে কমিশনের এ ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত। এসব ক্ষেত্রে কমিশন কিন্তু সহানুভূতি দেখায়ও। আইনগতভাবে স্ত্রীর অবৈধ সম্পদের বিষয়ে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনগত বিষয় হচ্ছে- তদন্তকারী কর্মকর্তা যখন তদন্ত করবেন, তখন তিনি এটি সিদ্ধান্ত নেবেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি বিশ^াস করেন যে, নারী না জেনে-বুঝেই সম্পদের মালিক হয়েছেন, তা হলে তিনি অবশ্যই সহানুভূতি পাবেন।
দুদক সূত্র বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গত ছয় বছরে এক হাজার ৮৪৮ মামলা করেছে দুদক। এর মধ্যে সম্পদের মামলা এক হাজার ৪০০টি। এ মামলাগুলোর মধ্যে এক হাজার ১২০টি মামলায় স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীদের আসামি করা হয়।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, এ ধরনের মামলায় অভিযুক্ত নারীরা বলছেন, তারা কিছু জানেন না, কিন্তু কাগজে তাদের সই আছে। তারাও কোম্পানি কিংবা প্রতিষ্ঠানের কোনো পদে আছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক চেক বা খালি চেকে সই করার আগে জানতে হবে তিনি কেন সই দিচ্ছেন।
নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, সচেতনতার অভাবে এবং পারিবারিক প্রধানের নানা অনৈতিক চাপে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধের অংশীদার হচ্ছেন নারীরা। আবার পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর সীমিত ক্ষমতা হওয়ার কারণে এসব ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। অপর্যাপ্ত স্বাধীনতার ফলে বেশিরভাগ নারীই এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারছেন না।
দুদকের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত নারীরা স্বামীর কথামতো কাগজে সই করেই সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাই স্ত্রীদের ব্যাংক হিসাব থেকে সব কিছুই পরিচালনা করেন স্বামীরাই। স্বামীর অবৈধ সম্পদ বা আয়ের উৎস স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্ত্রী জবাব দিতে ব্যর্থ হন। কিছু ক্ষেত্রে তারা স্বামীদের বাঁচাতেও চেষ্টা করেন। আবার অনেক সময় স্ত্রীকে রক্ষা করার বদলে স্বামী নিজেকে বাঁচাতে দাবি করেন যে স্ত্রীর সম্পদের হিসাব তিনি জানেন না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, স্ত্রীদের সচেতন হতে হবে। স্বামীর সম্পদের অংশীদার স্ত্রী-সন্তান কিংবা অন্যরা হতেই পারেন। এটি যদি অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ হয়, আর স্ত্রী যদি জেনেশুনে তার অংশীদার হন, তা হলে অবৈধ সম্পদ আহরণের জন্য তাকে দায়ী হতে হবে। আইন কিন্তু সেটিই বলছে। কাজেই এখানে প্রথম কথা হচ্ছে- স্ত্রী কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তারা যেন জেনেশুনে এই ফাঁদে পা না দেয়। অনেক সময় এটা মনে করা হয়, যোগসাজশে অবৈধ উপার্জন করা হয়। এখন স্ত্রীদের ধারণা থাকা দরকার, অবৈধ মালিকানা গ্রহণ করবেন নাকি করবেন না।
দুর্নীতির ঘটনায় আইনগতভাবে নারীর প্রতি দুদকের সহনশীল হওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তবে দুদকের দায়িত্ব হলো- তিনি জেনেশুনে কী করেছেন নাকি জেনেশুনে করেনি সেটি নিশ্চিত করা। দুদক নমনীয় অবস্থা নিতে চাইলে সে ক্ষেত্রে দুদক যেন প্রমাণ সাপেক্ষে নেয়। তবে আইনগতভাবে কোনো সুযোগ নেই।