ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের বিষয়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, এতে ভিন্নমত পোষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ বিভাগ। ফৌজদারি মামলা তদন্তে পুলিশ বাহিনীর বাইরে স্বতন্ত্র একটি সংস্থা গঠনের বিষয়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের কাছে নিজেদের ঘোর আপত্তির কথা জানাবে পুলিশ। বাহিনীটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন, স্বতন্ত্র সংস্থা গঠিত হলেই যে ফৌজদারি মামলার তদন্ত স্বচ্ছ, প্রভাবমুক্ত, দ্রুত ও মানসম্পন্ন হবে- এমন যুক্তির সঙ্গে তারা একমত নন। তাদের যুক্তি, স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা দিয়ে মামলা তদন্ত করা হলে তা আইনশৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা ও অপরাধ দমন কাজের ক্ষেত্রে বড় ছন্দপতন ঘটাতে পারে। বিচারপ্রার্থীরা এতে ভুক্তভোগী হবেন বলেও মনে করছেন তারা।
আইন মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন দাখিলকৃত প্রাথমিক প্রতিবেদনে ফৌজদারি মামলার তদন্তে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ফৌজদারি মামলার তদন্তকালে বর্তমানে সরকারি প্রসিকিউটরের তদন্ত তদারকির সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সমন্বয়ের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই আদালতে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। এতে শেষ পর্যন্ত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। প্রচলিত তদন্তব্যবস্থা এবং তাতে নিয়োজিত জনবলকে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে বিচারব্যবস্থায় তদন্ত প্রক্রিয়ার যথাযথ ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র, কার্যকর, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য, জনবান্ধব ও প্রভাবমুক্ত তদন্ত সংস্থা গঠন প্রয়োজন।
এ বিষয়ে পুলিশ বাহিনীর মতামত জানতে চেয়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গত ২ জানুয়ারি পুলিশের আইজিকে একটি চিঠি দেয়। ওই চিঠি পাওয়ার পর আইজিপি বাহারুল আলম গত বুধবার পুলিশের সব ইউনিটপ্রধান ছাড়াও পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। ওই আলোচনাতে অংশ নিয়ে অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের বিপক্ষে জোরালো মতামত দেন। এ ব্যাপারে পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে জোরালো আপত্তি জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। বৈঠকে অধিকাংশ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ বাহিনীর বাইরে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠিত হলেই যে মামলার তদন্ত প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ এবং দ্রুত হবে- এ যুক্তির সঙ্গে তারা একমত নন। বরং এতে আরও জটিলতা বাড়বে এবং অনেক মামলার তদন্ত আরও দীর্ঘ হবে। এতে বিচারপ্রার্থীরাই পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বৈঠকে পুলিশের কর্মকর্তারা আরও উল্লেখ করেন, স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা করতে হলে বড় বাজেট ও বিশাল জনবল, যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন হবে। তদুপরি তদন্ত
একটি বিশেষায়িত কাজ। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। নতুন সংস্থা গঠন এবং কার্যক্রম শুরু করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা, তদন্তে বিলম্ব ও কার্যকর সমাধানের
অভাব জনভোগান্তি বাড়িয়ে তুলতে পারে। অপরাধ তদন্তে দীর্ঘদিন ধরে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। বাহিনীটি অপরাধমূলক মামলা থেকে শুরু করে সংঘবদ্ধ অপরাধ, আর্থিক অপরাধ, সাইবার অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধের ঘটনা তদন্ত করে। স্থানীয় প্রেক্ষাপট, সামাজিক কাঠামো ও অপরাধের ধরন সম্পর্কে পুলিশ পরিচিত। যা নতুন বা বিকল্প তদন্ত সংস্থা থেকে পুলিশকে এগিয়ে রাখবে। তা ছাড়া ঘটনাস্থল বা অপরাধস্থলের কাছাকাছি না থাকলে অপরাধের গতি-প্রকৃতি বোঝা মুশকিল। নতুন তদন্ত সংস্থার ক্ষেত্রে এটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে।
বৈঠকে পুলিশের বাইরে কোনো তদন্ত সংস্থা গঠনের বিপক্ষে মতামত প্রদানের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিটি থানার অধীনে পৃথক তদন্ত ইউনিট গঠন, একটি স্বতন্ত্র ও জবাবদিহিমূলক প্রসিকিউশন সার্ভিস বা সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। পিবিআই ও সিআইডিকে আরও শক্তিশালী করার প্রস্তাব করা হয়। বৈঠকে আসা প্রস্তাব অনুযায়ীই তৈরি করা হচ্ছে পুলিশের মতামত।
জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, উপমহাদেশে ফৌজদারি মামলার তদন্ত দেড়শ বছর ধরে করে আসছে পুলিশ। কাজেই পুলিশের কাজটা পুলিশকেই করতে দেওয়া উচিত। আমরা এ ব্যাপারে তিন পৃষ্ঠার একটি মতামত তৈরি করেছি, যেখানে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতিবছর দেশের থানাগুলোয় এক লাখ ৭৫ হাজার ফৌজদারি মামলা রুজু হয়। এসব মামলায় থানা পুলিশের পাশাপাশি বর্তমানে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সিআইডি, পিবিআই ও গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করে থাকে। র্যাব তদন্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা আদালত থেকে ন্যস্ত করা মামলার। যে কোনো মামলার রহস্য উদঘাটনে পুলিশ বাহিনীতে রয়েছে ফরেনসিক ল্যাব, জীবাণু শনাক্তকরণ ডেটাবেজ, ডিএনএ ল্যাবসহ প্রযুক্তিগত অন্যান্য ব্যবস্থা।
মাঠপুলিশে হতাশা
পুলিশের বাইরে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাবের খবরে মাঠপুলিশে বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পুলিশের এসআই, ইন্সপেক্টর, এএসপিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের সঙ্গে আমাদের সময় কথা বলেছে। প্রত্যেকেই হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, পুলিশের বাইরে স্বাধীন তদন্ত সংস্থা হলে পুলিশের মনোবলে বড় রকমের চিড় ধরবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ দমনে।
বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ও সিআইডির অতিরিক্ত আইজি মো. মতিউর রহমান শেখ আমাদের সময়কে বলেন, তদন্ত জিনিসটার সার্বিক অর্থ অনেকেই ধরতে পারেন না। যেমন ধরুন, মামলা রেকর্ড হওয়ার পর ঘটনাস্থল ভিজিট করতে হবে, সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে হবে, আসামিকে রিমান্ডে আনতে হবে, মালামাল সিজ করতে হবে, এমনকি ডিজিটাল ফরেনসিক করতে হবে। বিশাল সুযোগ-সুবিধা না থাকলে এসব কাজ করা যাবে না। তদন্ত মানে এই নয় যে, ধরলাম আর শেষ করলাম; ফাইনাল করে চার্জশিট দিয়ে দিলাম। প্রতিটি স্টেপ আপনাকে ফলো করতে হবে। আমাদের তদন্তের প্রত্যেকটা স্টেজে জবাবদিহি করতে হয় কোর্টে। তদন্ত এতটাই সার্বিক বিষয় যে, এটা আপনি চট করে কাউকে দিয়ে করাতে পারবেন না। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন আর ১৯৪৩ সালের পিআরবি- এত বছরের প্রাকটিসের ধারাবাহিকতায় পুলিশ তদন্ত করে আসছে। তদন্ত অন্যান্য সংস্থাও করে। নারকোটিকস করে, দুদক করে, এনবিআর করে। তদন্তে আলটিমেট যে লক্ষ্য সাজা, সেটার প্রসেসগুলোও তদন্তের অংশ। সুতরাং, জুলাই-আগস্টের ঘটনার কারণে অনেকে মনে করতে পারেন যে, তদন্তটা হয়তো আলাদা করে দিলে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হবে। তবে আমি বলতে চাই, সিস্টেমেটিক ওয়েতে আগাতে হবে। যারা এখন তদন্ত করছে, তাদের শক্তিশালী করা, প্রশিক্ষিত করা বেশি প্রয়োজন। কারণ আমরা কাজটা জানি। আমাদের আপনারা আরও জ্ঞান দিয়ে সমৃদ্ধ করলে সত্যিকার অর্থেই দেশ উপকৃত হবে। এক্ষেত্রে আলাদা কোনো সংস্থা গঠনের কোনোই প্রয়োজন নেই।
জানতে চাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, থানা পুলিশের বাইরে প্রশিক্ষিত কর্মকর্তার মাধ্যমে তদন্ত করলে, সেটা ভালোই হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশে এটা করা হয়। প্রতিবেশি দেশ ভারতেও এই প্রাকটিস আছে। প্রাথমিকভাবে আমরা মেট্রোপলিটন এলাকায় শুরু করতে রি। তারপর পর্যায়ক্রমে জেলার থানার মামলার তদন্তভার অন্য সংস্থাকে দেওয়া যেতে পারে।