পর্দায় অপূর্ব উপস্থিতি, রোমান্টিক চরিত্রে একাকার হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, পরিপাটি দাঁত, মাধুরীমাখা হাসি, টানা মায়াবী চোখ, মধুমাখা কণ্ঠস্বর সব মিলিয়ে বাঙালি সৌন্দর্যবোধের নিখুঁত মিশ্রণ তাকে দিয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের দর্শকদের হৃদয়ে স্থান, করে তুলেছে মহারানী। পর্দার বাইরে ব্যক্তিত্ব, স্বেচ্ছা-নির্বাসন, রহস্যময় আচরণ তাকে ভক্ত এবং শুভানুধ্যায়ীদের কাছে করে তুলেছে অপ্রাপ্য; জন্ম দিয়েছে তীব্র আগ্রহ ও কৌতূহল। বলছি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের কথা। এত সফল এক অভিনেত্রী হয়েও জীবনের প্রথম সিনেমাটি তার মুক্তিই পায়নি! সময়টা ১৯৫২ সাল। ‘শেষ কোথায়’ নামের একটা সিনেমা দিয়ে রুপালি পর্দায় যাত্রা শুরু করেন সুচিত্রা। কপাল এতই খারাপ যে, ছবিটি কোনো দিন আর মুক্তিই পেল না; কিন্তু পরেরটা নিয়ে কথা আছেÑ উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে ৭৪’ ছবিটি পুরো বাঙালির মাথা খারাপ করে দিল! আর উত্তম-সুচিত্রা বলে একটা ট্রেন্ড চালু হয়ে গেল বাংলার রোমান্টিক জুটি হিসেবে। প্রায় ৩০টি ছবিতে জুটি হয়েছিলেন তারা। আর সুচিত্রা সর্বমোট অভিনয় করেছেন ৬১টি ছবিতে।
তার অভিনীত ‘দীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯), ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১), ‘সাত পাকে বাঁধা’ (১৯৬৩), ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৬৩), ‘আন্ধি’ (১৯৭৫) ছবিগুলো বাংলা চলচ্চিত্রে ইতিহাস হয়ে আছে। এর মধ্যে ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিতে যৌনকর্মী পান্নাবাই ও তার মেয়ে আইনজীবী সুপর্ণা দুটি চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা। ‘আন্ধি’ ছবিটি তো মুক্তির পর ২০ সপ্তাহ নিষিদ্ধ ছিল গুজরাটে। ধারণা করা হয়েছিল, তার চরিত্রটি চিত্রিত হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া অবলম্বনে। ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর সেই রাজ্যের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার হয় ছবিটি। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস অবলম্বনে বলিউডে নির্মিত ‘দেবদাস’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা। এতে অনবদ্য অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি।
ভীষণ জনপ্রিয় আর ব্যস্ত অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন সুচিত্রা সেন। এমন ব্যস্ত যে, স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও তার শিডিউল পেতেন না। শিডিউল পাননি বলে তিনি ‘চৌধুরানী’ ছবিটি বানালেনই না! ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ সিনেমার জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ পুরস্কার জিতে নেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী, যিনি এই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পুরস্কারটি পেয়েছিলেন। পরে ভারত সরকার ১৯৭২ সালে তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে।
টানা ২৫ বছর অভিনয়ের পর ১৯৭৮ সালে অবসরে যান সুচিত্রা সেন। সেই থেকে তিনি চলে যান লোকচক্ষুর আড়ালে। নেপথ্যে থেকেই রামকৃষ্ণ মিশনের মাধ্যমে মানবসেবা শুরু করেন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। সরাসরি গিয়ে নিতে হবে বলে পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। সুচিত্রা চেয়েছিলেন, তার যে অপরূপ রূপ মানুষ দেখেছে, তাদের হৃদয়ে সেই ছবিই জ্বলজ্বলে থাকুক। ২০১২ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করা হয় সুচিত্রা সেনকে। ২০১৪ সালের আজকের দিনে পরপারে পাড়ি জমান সুচিত্রা সেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে এ মহানায়িকার প্রতি রইল আমাদের সময়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
চিরদিনের উত্তম-সুচিত্রা
জুটি বেঁধে উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন বাঙালিকে উপহার দিয়েছেন ৩০টিরও অধিক ছবি, যার প্রায় সবগুলোই সিনেমার ব্যবসায়িক মানদণ্ডে ‘সুপারহিট’। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরÑ এই তিন দশক রুপালি পর্দায় তো ছিলেনই, স্যাটেলাইট টেলিভিশন আর ভিডিও প্রযুক্তির কল্যাণে এই জুটি জনপ্রিয় পরের প্রজন্মগুলোর কাছেও। রোমান্টিকতায় ভরপুর এই জুটি বাঙালিকে শিখিয়েছিলেন, কীভাবে ভালোবাসতে হয়। কীভাবে রোমান্টিক বাতাবরণ তৈরি করে উত্তেজনায় কাঁপিয়ে দিতে হয় সবাইকে। তাই বলাই যায়Ñ উত্তম-সুচিত্রা জুটি রুপালি পর্দার এমনই এক প্রেমিক-যুগল, যা চিরদিনের। দুজনের প্রথম হিট ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া হাসির এ ছবিতে উত্তম কিংবা সুচিত্রা কেউই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেননি। ছবিটি যখন মুক্তি পায়, তখন ছাপানো পোস্টারে উত্তম-সুচিত্রার কোনো পাত্তাই ছিল না; কিন্তু ছবিটিতে তাদের রোমান্টিক অভিনয় বাংলা সিনেমার জগতে যেন এক প্রলয়ের ডাক দিয়ে যায়। এর পর ‘পথে হলো দেরী’, ‘মরণের পর’, ‘শাপমোচন’, ‘শিল্পী’, ‘সাগরিকা’, ‘হারানো সুর’, ‘সবার উপরে’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘সপ্তপদী’, ‘জীবনতৃষ্ণা’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘আলো আমার আলো’র মতো ছবিতে এই জুটি দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে সিনেমায় রোমান্টিসিজমের ধারাটাই পাল্টে দেন সম্পূর্ণরূপে; হয়ে যান নারী-পুরুষের সম্পর্কের রোমান্টিকতার ধারণায় বাঙালির চিরকালীন এক আইকন।