রবিবার, ০২:২৯ অপরাহ্ন, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

সীমা লঙ্ঘন করে বড় গ্রাহকদের ঋণ

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫
  • ৩ বার পঠিত

একটি ব্যাংক ঋণের কত অংশ বড় গ্রাহকদের দিতে পারবে, তার সীমা দেওয়া আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক বছরের পর বছর সেই সীমা লঙ্ঘন করে বড় গ্রাহকদের অনুকূলে ঋণ বিতরণ করে যাচ্ছে। এতে গুটিকয়েক গ্রাহকের কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণের বড় একটি অংশ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। মাত্র পাঁচ শাখার মাধ্যমে অধিকাংশ ঋণ দেওয়া হয়েছে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে মানা হয়নি একক গ্রাহকের সীমাও। এই আগ্রাসী ব্যাংকিং ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও মূলধন হারানোর ঝুঁকি বাড়িয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই ঝুঁকি কমাতে বড় গ্রাহক থেকে আদায় জোরদার ও ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

ব্যাংকগুলো বরাবরই বড় অংকের ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। এসব ঋণে প্রভাবশালীদের চাপ এবং নানা অনিয়ম-দুর্নীতি বেশি হয়। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের সক্ষমতা ও ঝুঁকি বিবেচনা না করে এবং উপযুক্ত জামানত ছাড়াই ঋণ তুলে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাংকগুলোতে ঋণের নামে যে লুটপাট হয়েছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বড় গ্রাহকরা। এখন সেসব গ্রাহকের প্রকৃত চিত্র দেখানো শুরু করায় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণও ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়েছে। এতে তাদের মূলধন হারানোর ঝুঁকিও বেড়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত এই চার ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ২০০৭ সাল থেকে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৪ সালেও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমওইউ স্বাক্ষর হয়। এমওইউতে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, ঋণের প্রবৃদ্ধি যথাযথ রাখা, বৃহদাঙ্ক ঋণের এক্সপোজার কমিয়ে আনা ও ঋণ বিকেন্দ্রীকরণ, খেলাপি ঋণ ন্যূনতম সীমায় নামিয়ে আনা, শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে নগদ আদায় জোরদার ও পরিচালন ব্যয় কমানোসহ নানা শর্ত আরোপ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে বেঁধে দেওয়া বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা ও শর্ত পূরণের অগ্রগতি নিয়ে পৃথক বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা অংশগ্রহণ করেন।

বৈঠকে উপস্থাপিত এমওইউ’র পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চার ব্যাংকই বড় গ্রাহকদের সীমা লঙ্ঘন করে ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক ৩০ শতাংশ সীমার বিপরীতে দিয়েছে রেকর্ড ৭৭ শতাংশ। একই পরিমাণ সীমার বিপরীতে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ। সোনালী ব্যাংক ৩৮ শতাংশের জায়গায় দিয়েছে ৪০ শতাংশ। আর রূপালী ব্যাংক দিয়েছে ৩১ শতাংশ, যা ব্যাংকটির সীমার চেয়ে ১ শতাংশ বেশি। বড়দের কাছে ঋণের বড় অংশ আটকে যাওয়ায় ঝুঁকি বৃদ্ধির আশঙ্কা করে আদায় জোরদারের পাশাপাশি ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের পরামর্শ দেন গভর্নর।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, বড় গ্রাহকদের ঋণের তথ্যই বেশি লুকানো হয়, সেটা এখন বেরিয়ে আসছে। এটা কমাতে ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে ঋণ বিকেন্দ্রীকরণ তথা ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ বাড়াতে হবে। এগুলোর জন্য যারা দায়ী তাদেরও বিচারের আওতায় আনা উচিত। আগামীতে কমপ্লায়েন্স করে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ দেন তিনি।

এমওইউ’র পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের ঋণ বিতরণের স্থিতি ছিল ৯৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৪৯ জন গ্রাহকের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৭৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা বা ৭৭ শতাংশ। অথচ নিয়মের মধ্যে তাদের পাওয়ার কথা ছিল ২৯ হাজার ৩১০ কোটি টাকা বা ৩০ শতাংশ। এই ঋণের মধ্যে ফান্ডেড ৬৮ হাজার ৭৫৬ কোটি এবং নন-ফান্ডেড ৬ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি কাউকে ঋণ দিতে পারে না। জুন পর্যন্ত জনতা ব্যাংক নিয়ম ভেঙে ২২ গ্রাহকের অনুকূলে ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের ৭৭ শতাংশই পাঁচ শাখার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। যদিও পাঁচ শাখার ঋণ ৩০ শতাংশের নিচে রাখার নির্দেশনা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবর রহমান বলেন, বড় গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এ ছাড়া ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইনিভাবে প্রস্তুতি নেওয়া আছে।

গত জুন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ছিল ৭৫ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩১ হাজার ৪১৫ কোটি টাকাই ৫৬ গ্রাহকের কাছে, যা বড় গ্রাহকদের পোর্টফোলিওর প্রায় ৩৫ শতাংশ। কিন্তু ব্যাংকটির এই সীমা দেওয়া আছে ৩০ শতাংশ। এ নিয়মে ঋণ দিলে এই ৫৬ জন গ্রাহকের ঋণ পাওয়ার কথা ২২ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকটি ২৫ জন গ্রাহকের ক্ষেত্রে ঋণ বিতরণে একক গ্রাহকের সীমা লঙ্ঘন করেছে। অন্যদিকে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪২ শতাংশই পাঁচ শাখায়।

এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, গ্রাহককে সীমার বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রে যথাসময়ে ঋণ ফেরত না এলেও সীমা অতিক্রম হওয়ার ঘটনা ঘটে। কারণ পরপর কিস্তি অনাদায়ী থাকলেও সুদসহ আসলের পরিমাণ বেড়ে যায়। এসব ঋণের ক্ষেত্রে তেমন ঘটে থাকতে পারে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ঋণস্থিতি ছিল ৯৮ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৭ জন গ্রাহকের কাছেই ৩৯ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকার ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে, যা ব্যাংকটির ঋণ পোর্টফোলিওর ৪০ শতাংশ। অথচ ব্যাংকটির বড় ঋণ পোর্টফোলিওর সীমা দেওয়া আছে ৩৮ শতাংশ। এটা মেনে ঋণ দিলে এই ১৭ গ্রাহকের পাওয়ার কথা ৩৭ হাজার ৬০১ কোটি টাকা। এ ছাড়া জুন পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক নিয়ম ভেঙে ১১ গ্রাহকের অনুকূলে মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৩৪ শতাংশ পাঁচ শাখায়। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খানের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, বড় গ্রুপগুলোর কয়েকটির ঋণ অনিয়মিত হয়ে গেছে। তাই এখন বড় ঋণ দিচ্ছি না। ছোট ঋণে মনোযোগ দিচ্ছি। সেই সঙ্গে কিছু গ্রুপের ঋণ আদায়ে জোরাল চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের জুন পর্যন্ত ঋণ স্থিতি ছিল ৪৯ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ হাজার ২৫৯ কোটি টাকাই ৩৫ জন গ্রাহকের কাছে, যা পোর্টফোলিওর ৩১ শতাংশ। ব্যাংকটির এই ঋণের সীমা দেওয়া আছে ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংকটির মোট ঋণের ৫৬ শতাংশই পাঁচ শাখায় পুঞ্জীভূত। সেই সঙ্গে ব্যাংকটি নিয়ম ভেঙে ১৪ জন গ্রাহকের অনুকূলে মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে। এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলামের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের জুনভিত্তিক আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে অন্তত ১৮টি ব্যাংক ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেট রেশিও (সিআরএআর) সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়নি। জানা গেছে, এ তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নামও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। এটি পুরো ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪১ শতাংশ।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com