চার কোনা আকৃতির আধা পোড়া মাটির টুকরো। দেখতে অনেকটা বিস্কুটের মতো। সিলেট নগরীর চাঁদনীঘাট এলাকায় ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে এ মাটির বিস্কুট। সিলেটের লোকজন এটাকে ‘ছিকড়’ নামেই চেনেন। একসময় দরিদ্র অভাবী লোক বিকল্প খাবার হিসেবে খেতেন মাটির এ বিস্কুট। এরপর বিভিন্ন বিশ্বাস নিয়ে এ ছিকড় খেতে শুরু করেন নারীরা। বিশেষ করে গর্ভবতীরা নিজের এবং গর্ভস্থ বাচ্চার সুস্থতার জন্য খেয়ে থাকেন অদ্ভুত এ বিস্কুট। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সিলেটের অনেক নারীও দেশ থেকে নিয়ে যান এ ‘ছিকড়’। চিকিৎসকরা বলছেন, মাটির তৈরি এই বিস্কুটে কোনো পুষ্টিগুণ নেই। বরং গর্ভাবস্থায় আধপোড়া মাটির এ বিস্কুট খেলে গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় গ্রামের অভাবগ্রস্ত লোকজন বিকল্প খাবার হিসেবে মাটির তৈরি এ বিস্কুট খেতেন। ছিকড় মূলত তৈরি হয় এঁটেল মাটি দিয়ে। এটা তৈরির কারিগররা প্রথমে পুকুর বা জলাভূমির তলদেশের গভীর থেকে কিংবা পাহাড় ও টিলার গভীর থেকে গন্ধযুক্ত মাটি সংগ্রহ করেন। এরপর তা চার কোনা বিস্কুট আকৃতি দিয়ে রোদে শুকিয়ে নেন। শুকিয়ে শক্ত হওয়ার পর মাটির বিস্কুটগুলো আগুনে পুড়িয়ে খাবার উপযোগী হয়। ‘ছিকড়’ শব্দটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। ‘ছিয়া’ অর্থ কালো, আর ‘কর’ অর্থ মাটি। অর্থাৎ ‘ছিয়াকর’ অর্থ কালো মাটি। ছিয়াকর শব্দটি কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে সিলেটের মানুষের কাছে কালো এঁটেল মাটির তৈরি বিস্কুটটি ‘ছিকড়’ নামেই পরিচিতি পেয়েছে। ছিকড় এক সময় হবিগঞ্জে তৈরি হতো। হবিগঞ্জের মানুষের কাছেই বেশি পরিচিত ছিল মাটির এই বিস্কুট। বিশেষ করে জেলার দরিদ্র মানুষের বিকল্প খাবার হিসেবে এ ছিকড়ের কদর ছিল। ধীরে ধীরে মানুষের সচ্ছলতা ফিরলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এ বিশেষ খাবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সিলেট বিভাগের বাকি তিন জেলার মানুষের কাছেও। রক্ত স্বল্পতারোধ ও গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতার উপশমসহ নানা বিশ্বাসে সিলেট বিভাগের নারীরা এ অদ্ভুত বিস্কুটটি খেতেন। বয়স্ক নারীরা জানান, গর্ভাবস্থায় তারা খাবার খেতে পারেন না। খাবারে গন্ধ লাগে। খাবার সামনে আনা হলে অনেকের বমি বমি ভাব হয়। কারও কারও রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। এতে গর্ভবতী নারীরা দুর্বল হয়ে পড়েন। এ সময় গর্ভবতীদের ‘ছিকড়’ খেতে দেওয়া হয়। তেঁতুল কিংবা টক জাতীয় কিছু মিশিয়ে নারীরা এ বিস্কুটটি খেয়ে থাকেন। বিকল্প খাবার হিসেবে গর্ভবতীরা এ বিস্কুট খেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অনেক পরিবারে গর্ভবতীদের সঙ্গে সুস্থ নারীরাও এ ‘ছিকড়’ খেয়ে থাকেন। এ বিস্কুট নারীদের অনেক রোগ প্রতিরোধ করে থাকে এমন বিশ্বাস থেকেই তারা এটি খান। চাঁদনীঘাটের ছিকড় বিক্রেতা হাফিজুর রহমান জানান, বংশ পরম্পরায় তিনি এ পণ্যটি বিক্রি করে আসছেন। বেশিরভাগ ক্রেতাই নারী। এ বিস্কুট খেলে গর্ভবতী নারী ও শিশু উভয় সুস্থ থাকেন এমন বিশ্বাস থেকে এটি কিনেন ক্রেতারা। অনেক সময় যুক্তরাজ্যে পাঠানোর জন্য কেউ কেউ এ বিস্কুট কিনে প্যাকেট করে নেন। উপশহরের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম জানান, যুক্তরাজ্য প্রবাসী তার দাদির জন্য বছরে দু-তিনবার ছিকড় পাঠিয়ে থাকেন। প্রতিদিন এ বিস্কুটটি খাওয়া তার দাদির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত জানান, মাটির তৈরি এ বিস্কুটের প্রমাণিত কোনো পুষ্টিগুণ নেই। নারীরা অন্ধ বিশ্বাসে এটি খেয়ে থাকেন। এটি গর্ভবতীদের উপকারের চেয়ে ক্ষতি করার আশঙ্কা থাকে।