এক সময়ের সহজলভ্য প্রোটিনের উৎস ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিমের নাগাল পেতে এখন বেজায় বেগ পেতে হচ্ছে ভোক্তাদের। কারন বাজারে এগুলোর দাম বিগত কয়েক দিন ধরে লাফিয়ে বাড়ছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানির বিভিন্ন বাজারে ব্রয়লার মুরগি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত এবং প্রতি ডজন ডিম ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্য দুটির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অস্বস্তিতে রয়েছেন সব শ্রেনীর ভোক্তারা। আমিষনির্ভর পুষ্টির প্রায় অর্ধেক চাহিদা মুরগি ও ডিম থেকে পূরণ হলেও এখন তা কিনে খেতে পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। এমনকি অনেক মধ্যবিত্তের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ পড়ছে মুরগির মাংস ও ডিম ভাজি।
মালিবাগের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবি মো. মোস্তাক আহমেদের এ সপ্তাহের বাজারের লিস্ট থেকেও বাদ পড়েছে মুরগি ও ডিম। কথা হলে তিনি বলেন, মাছ-মাংসের যে দাম তাতে ভরসা ছিল ব্রয়লার। সেটার দামও বাড়তে বাড়তে এখন নাগালের বাইরে। দেড় থেকে দুই কেজির নিচে তো আর ব্রয়লার কেনা যায় না। তাতে যে দাম আসে তা আমার সাধ্যের বাইরে।
গেল মাস থেকেই ব্রয়লার ও ডিমের বাজার ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। সর্বশেষ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এই গতিকে আরও এক ধাপ উসকে দিয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রয়লার মুরগির কেজিতে দাম বেড়েছে ৪০ টাকা এবং ডিমের দাম ডজন প্রতি বেড়েছে অন্তত ২০ টাকা। দাম বাড়ার বিষয়ে বরাবরের মতো একে অপরকে দোষারোপ করছেন আড়ৎদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর মালিবাগ বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী মো. ফারুক বলেন, আমাদের হাতে দামের নিয়ন্ত্রণ নেই। গতকালের (বৃহস্পতিবার) চেয়ে আজ (শুক্রবার) কাপ্তান বাজারের পাইকারিতে বেশি দরে মুরগি কিনতে হয়েছে। ৫ থেকে ৭ টাকা খরচবাবদ রেখে সে মুরগি ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। কোথাও কোথাও ১৯০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত সপ্তাহের শুরুর দিকে বিক্রি হয়েছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়। ফারুকের এ হিসাব অনুযায়ী, সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে ব্রয়লারের দাম ২২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়েছে।
কাপ্তানবাজারের পাইকার মো. জসিম মিয়া বলেন, খামারে দাম বেড়েছে। আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ট্রাক ভাড়া বেড়েছে। তাই দাম একটু বেশি বাড়তি এখন।
অপরদিকে খামারিরা বলছেন, উৎপাদনে খরচ বাড়ায় সপ্তাহের ব্যবধানে খামার পর্যায়ে মুরগি ও ডিম দাম কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে অতিরিক্ত হারে বেড়েছে। মূলত যাদের হাত হয়ে ভোক্তা পর্যন্ত পৌছাচ্ছে তারাই নানা অযুহাতে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়াচ্ছে।
একাধিক খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন মাসের ব্যবধানে পোল্ট্রি ফিডের দাম ৩২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় মুরগির দাম বাড়তি রয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে খামারি পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চলতি সপ্তাহে দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা দরে। গত সপ্তাহে যা ছিল ১৩০ টাকা কেজি। স্থানীয় পাইকাররা এ দামে মুরগি কিনে তা রাজধানীর পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। পরবর্তীতে তারা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করেন। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খামারি থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌছাতে দাম ৩০ টাকার বেশি বাড়ার কথা নয়। সেখানে দাম বাড়ছে ৫৫ টাকা। অর্থাৎ তিন হাত বদলে অন্তত ২৫ টাকা অতিরিক্ত দাম বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সদস্য নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ৩২ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে খামারিদের ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করে দিতে হয়। নইলে খাবার খরচ হলেও এরপর মুরগির ওজন খুব একটা বাড়ে না। স্থানীয় পাইকাররা এর সুযোগ নিয়ে খামারিদের কাছ থেকে কম দামে মুরগি কেনেন এবং তা রাজধানীর পাইকারদের কাছে বাড়তি দামে বিক্রি করেন। জ্বালানির দাম বাড়ার অযুহাতে এখন তারা আরও বেশি দাম রাখছেন।
মধ্যস্বত্বভোগী আর সিন্ডিকেটদের হাতে প্রান্তিক খামারিরা জিম্মি হয়ে আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সিন্ডিকেট চক্র সারাদেশে সক্রিয়। তারা ফোনে ফোনে মুরগির দাম ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। সেই দামে খামার থেকে মুরগি সংগ্রহ করে পাইকারদের সরবরাহ করছেন। এই সিন্ডিকেটের জাল না ভাঙলে বাজারে অস্থিরতা কমবে না, খামারিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ডিমের বাজারেরও একই দশা। সেখানেও পুরো নিয়ন্ত্রণ ওই সিন্ডিকেটের হাতেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুরগির মতো ডিমের দামও এলাকা ও সময় ভেদে পরিবর্তন হতে থাকে। মধ্যস্বত্বভোগীদের কয়েকটি চক্র ফোনে ফোনে বিভিন্ন এলাকায় ডিমের দাম ঠিক করে দেয়। সে দামেই কেনা-বেচা হয় ডিম। অনেক খামারিরা জানান, এমনও হয় যে সকালে এক দাম আবার বিকালে আরেক দামে ডিম কেনেন পাইকার ও আড়তদাররা।
গাজীপুরের খামারি মো. হাসিব মোল্লা জানান, স্থানীয় পাইকাররা খামারিদের কাছ থেকে ডিমের শ’ (১০০) পিস ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায় কিনে নিয়ে যান। পড়ে হাত বদলে তার দাম আরও বেড়ে যায়। মৌসুম ভেদে খামারিদের লাভ-লোকসান হলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের কখনই লোকসান হয় না। বরং সুযোগ বুঝে তারা অতিরিক্ত লাভ করেন। এভাবে খামারিদের ঠকানো হচ্ছে।
এগ প্রডিউসার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকীও আমাদের সময়কে বলেন, উৎপাদন পর্যায়ে খামারিদের প্রতিপিস ডিমে বর্তমানে কমবেশি ৮ টাকা খরচ হয়। বিক্রি করতে গেলে আড়তদারদের কাছ থেকে সাড়ে ৮ টাকার মতো দাম পান খামারিরা। অথচ, খুচরা বাজারে এই ডিম ১২ থেকে ১৩ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে। এ থেকেই বোঝা যায় কি পরিমান মুনাফা করেন মধ্যস্বত্ব্যভোগীরা। ডিমের দাম কত হবে তা নিয়ে কোন নিয়ম-নীতি নেই। মিডেল-ম্যানরা যেটা ঠিক করেন সে অনযায়ী চলে। এভাবেই চলে আসছে। এর ফলে খামারিরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ভোক্তাদেরও বেশি দামে ডিম কিনে খেতে হচ্ছে।
রাজধানীর মালিবাগ বাজারের ডিম ব্যবসায়ী রুহুল আমিন জানান, ফার্মের ডিমের ডজন (১২ পিস) এখন ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। বাছাই করা বড় আকারের ডিমের বেলায় দাম পড়ছে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। গত সপ্তাহে ফার্মের ডিম ১২০ টাকাতে বিক্রি হয়েছে। রুহুলের এ হিসাব অনুযায়ী এক সপ্তাহে ডিমের দাম ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেড়েছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকালের বাজার প্রতিবেদনও বলছে সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লারের দাম ১৬ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অপরদিকে ডিমের দামও ১৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে পণ্য বিতরণ, বিপণনে খরচ বাড়বে, পণ্যমূল্যও বাড়বে। তবে যতটা বাড়ার কথা তার থেকেও বেশি বাড়ানো হচ্ছে। মূলত হাত বদলের সংখ্যা যত বাড়বে দাম ততই বাড়বে। দাম সমানুপাতিকভাবে না বেড়ে অতিরিক্ত বাড়ছে। এই হাত বদলের সংখ্যা কমাতে হবে। নইলে খামারিরাও ঠকবেন, আবার বেশি দামে পণ্য কিনে ভোক্তারাও প্রতারিত হবেন।